গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বাধ্যবাধকতা না থাকায় শিগগিরই শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে আগ্রহী নয় জামায়াতে ইসলামী। দলটির ‘ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব’কে ভারমুক্ত করার আপাতত কোনও চিন্তা নেই। এ ক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কারাবন্দি দলের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ার আগে আমির নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে না জামায়াত। এরপর রুকন সম্মেলনের সুযোগ না থাকলে ‘মেইল বা খামে’ গোপন ব্যালটের মাধ্যমে তিনজনের প্যানেল থেকে আমির নির্বাচন করা হবে। তবে গঠনতান্ত্রিক নিয়ম অনুসারে উপজেলা-থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করে আনা হয়েছে। জামায়াতের দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ের অন্তত ৬ জন নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, জামায়াতে ইসলামীর আমির নির্বাচনের সময়সীমা ৩ বছর। তবে চলতি বছরের জুনে মুদ্রিত দলটির গঠনতন্ত্রের ৫৯তম সংস্করণের ধারা ১৫ এর ৬ এর (ঘ) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বিবেচনায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমিরে জামায়াতের নির্বাচন অনুষ্ঠান যদি কিছুতেই সম্ভব না হয়, তাহা হইলে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত আমির কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার অনুমোদন সাপেক্ষে স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন।’ এ কারণে গঠন তন্ত্র অনুযায়ী বাধ্যবাধকতা তৈরি না হওয়ায় ৩ বছরের জায়গায় বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ দুই সেশন ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। কারাবন্দি মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিচারাধীন। এ কারণে নিজামীর পরিণতি না দেখে আমির পরিবর্তনের বিষয়ে ভাবছেন না জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা।
ইতোমধ্যে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তার পদটি খালি রয়েছে। যদিও বিগত দুই সেশন ধরে ভারপ্রাপ্ত দিয়েই চলছে দলের গুরুত্বপূর্ণ এই পদ। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান। তিনি আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে রয়েছেন। বর্তমানে ডা. শফিকই জামায়াতের শীর্ষনেতা হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছেন।
জামায়াতের ঢাকা মহানগরের এক নেতা জানান, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর রায়টি যেহেতু ঝুলে আছে, সেহেতু এ নিয়ে চূড়ান্ত কিছু হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। অন্যদিকে, ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ দীর্ঘদিন ধরে দলের শীর্ষপদে রয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে আত্মগোপনে থেকে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ কারণে তাকে বাদ রেখে অন্য কাউকে আমির বানানোর ইচ্ছা আপাতত দলের কোনও স্তরেই নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, জামায়াতের নায়েবে আমিরদের মধ্যে অধ্যাপক একে এম নাজির আহমাদ মারা গেছেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। গত ৯ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি অবস্থান মারা যান নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসূফ। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সোবহান। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম ও মীর কাসেম আলী কারাবন্দি। বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এর বাইরে সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন। আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ারও পুলিশের করা বিভিন্ন নাশকতার মামলায় কারাগারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমির নির্বাচন অনেকটাই জরুরি হয়ে পড়েছে জামায়াতের। পাশাপাশি খালি হওয়া পদগুলোয় মনোনয়ন দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে দলটি।
জামায়াত সূত্র জানায়, সরাসরি সম্মেলন করে রুকনদের ভোটগ্রহণ সম্ভব না হলে ব্যালটের মাধ্যমেই আমির নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করবে দলটি। মতিউর রহমান নিজামীর বিষয়টি সুরাহা হলেই এই প্রক্রিয়ায় হাত দেবেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। আমির নির্বাচনের জন্য তিনজনের প্যানেল দেওয়া হবে। এই তিনজন থেকেই আমির নির্বাচন করবেন সারাদেশের রুকনরা। তবে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদকেই প্রথম পছন্দ দলের এই মুহূর্তেও নীতিনির্ধারকদের। সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে ডা. শফিকুর রহমানের পরিবর্তনের সম্ভাবনা আপাতত কম। এর বাইরে নতুন নায়েবে আমির ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ, অধ্যাপক তাসনীম আলম, ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, মাওলানা আবদুল হালিম উল্লেখযোগ্য।
জানতে চাইলে জামায়াতের কোনও দায়িত্বশীলই এ নিয়ে পরিষ্কার কোনও মন্তব্য করতে চাননি। দলটির নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এ প্রতিবেদকে বলেছিলেন, কেন্দ্রের নির্বাচন তো তিন বছর পর পর। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়েছে। তবে শিগগিরই নতুন কমিটির কোনও সম্ভাবনা নেই।
এ নিয়ে কোনও মন্তব্যই করতে রাজি হননি দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা যাইনুল আবদীন। তিনি বলেন, এ নিয়ে দায়িত্বশীলরা বলবেন। একই মন্তব্য করেন সিলেট জেলা দক্ষিণের আমির মাওলানা হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, আপাতত নতুন সম্ভাবনা নেই। তবে কেন্দ্র ঠিক করবে, কী হবে।