বিএনপির তিন নেতার ভারত সফর নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে দলে ও দলের বাইরে। তাদের এই সফর প্রতিবেশী দেশটি নিয়ে দলের অভ্যন্তরে ‘ইতিবাচক মনোভাব’ তৈরি হলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকারের পররাষ্ট্র নীতিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়ায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন বিএনপির নেতারা। বিশেষ করে তিন নেতার এই সফর তারেক রহমানের সম্মতিগ্রহণে হওয়ায়, এ নিয়ে নীরব ঢাকার নেতারা। এই ইস্যুতে দলের অভ্যন্তরে বিরোধপূর্ণ রাজনীতির যাত্রা শুরু হলো বলে জানিয়েছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা।
গত সপ্তাহে ভারত সফরে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস-চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও তারেক রহমানের উপদেষ্টা বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির। ওই সফরে তারা ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি, বিরোধী দল কংগ্রেস, সে দেশের তিনটি এনজিও, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, ‘সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আগামী নির্বাচন ইস্যুতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনীতিকদের সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে আলোচনা হয়। এতে বলা হয়, যাদের যে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, তারা নিজ উদ্যোগে বিদেশি বন্ধু রাজনীতিকদের সঙ্গে কথা বলুন। এটাও বলা হয় যে, আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আপনারা বিএনপির পাশে দাঁড়ান।’
বিএনপির ফরেন উইংয়ের একটি প্রভাবশালী সূত্র জানায়, ‘ভারত সফর করতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কনসার্ন ছিল। তার সম্মতি নিয়েই আমীর খসরু, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও হুমায়ুন কবির ভারতে যান। তাকে (তারেক রহমান) বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি রাজনৈতিকভাবে আদায় করতে হলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া দরকার এবং নির্বাচনে ভারতকে প্রয়োজন।’
তিন নেতার ভারত সফর নিয়ে শুরুতে কোনও প্রশ্ন না থাকলেও গত ৮ জুন দেশটির দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে হুমায়ুন কবিরের বক্তব্যে বিএনপির মধ্যে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গত দুই দিন ধরে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন।
দ্য হিন্দুর খবরে বলা হয়, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেছেন, ‘পেছনে ফিরে তাকানোর পরিবর্তে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। ৮০ ও ৯০ এর দশকের রাজনীতি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’ তারেক রহমানের উপদেষ্টা হুমায়ুন আরও বলেন বলেন, ‘তারেক রহমান চান, আমরা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হই। এখন উভয় দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীই আমাদের প্রধান অগ্রাধিকারের বিষয়।’ এছাড়া, বিএনপি সরকারের বিগত আমলগুলোতে ভারত ও বাংলাদেশের খারাপ সম্পর্কের নীতিকে ‘ভুল ও বোকামি’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এই বক্তব্যের পর বিএনপি নেতাদের মধ্যে তোলপাড় তৈরি হয়। নেতারা একে-অপরে উৎসুক হয়ে জানতে চাইছেন, ভারতের বিষয়ে সহমর্মী হওয়ার বিনিময়ে নিজেদের বিগত দিনের পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া কেন?
দলের একজন আন্তর্জাতিক সম্পাদক বলেন, ‘আমাদের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। রাজনৈতিকভাবে ভারতবিরোধী অবস্থানের কারণেই ভারতঘেঁষা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট পায় বিএনপি। আর এই নীতিটিকে ভুল প্রমাণিত করে কার ভোট পাওয়া যাবে—প্রশ্ন রাখেন এই নেতা।
সূত্র বলছে, সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে সর্বস্তরে হতাশা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার শাসনামলের পররাষ্ট্রনীতিকে ভুল বলে রাজনৈতিকভাবেই মার খেয়েছে বিএনপি—এমনটি মনে করেন অনেকে।
এ বিষয়ে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নওশাদ জমির বলেন, ‘শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি ভারত বা যেকোনও দেশের সঙ্গেই যে ভুল বা নির্বুদ্ধিতা ছিল না, বরং ভ্রান্ত তারা, যারা সময় ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেন। তারাই ভুল পথে রয়েছেন।’
জানতে চাইলে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ভারতে কারা গেছেন, এটা ব্যক্তিগত সফরও হতে পারে। আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না।’
তিন নেতার সফর কী ধরণের ছিল—-এমন প্রশ্নের উত্তরে শনিবার রাত সোয়া বারোটার দিকে আন্তর্জাতিক উইংয়ের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘সবমিলিয়েই ছিল।’
বিএনপির আন্তর্জাতিক উইং সূত্র বলছে, ভারতে গিয়ে তিন নেতার নতুন অবস্থান ব্যক্ত করার পর গত দুইদিনে ঢাকায় নিযুক্ত কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রের দূতাবাসের কর্মকর্তারাও প্রশ্ন করেছেন, দলের নতুন অবস্থান নিয়ে।
সূত্রটি বলছে, দলে সিদ্ধান্ত ছিল— সব বন্ধু রাষ্ট্রকে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে নীতিগত অবস্থান গ্রহণে অনুরোধ করার। এই সিদ্ধান্ত ভারতের পাশাপাশি চীন, সৌদি আরব, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই।
বিএনপির আন্তর্জাতিক উইংয়ের তিন সদস্য জানান, ভারত সম্পর্কে বিএনপির পর্যবেক্ষণ স্থিতিশীল রাখার সিদ্ধান্ত ছিল। ২০১৬ সালে একটি প্রতিবেদনে খালেদা জিয়াকে দেওয়া হয়েছিল— যেখানে বলা হয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগের চেয়ে ভারত বিএনপিকে কখনও প্রাধান্য দেবে না। পরবর্তী বছরগুলোয় এই প্রতিবেদন মোতাবেক আচরণ ছিল বিএনপির। গত ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর নতুন করে ভারত সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান পাল্টাতে শুরু করে। খালেদা জিয়ার গ্রেফতারের পর আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভারত বিষয়ে নতুন অবস্থান গ্রহণ করতে তারেক রহমানকে উৎসাহ যোগান। যদিও এই টিমে যুক্ত হন আবদুল আউয়াল মিন্টুও।
সূত্রের ভাষ্য, আবদুল আউয়াল মিন্টর সঙ্গে ভারতের একটি গোষ্ঠীর সুসম্পর্কের ভিত্তিতেই ভারত সফরে তাকে যুক্ত করা হয়। বিষয়টি নিয়ে শনিবার রাতে তাকে ফোন করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী জানান, তিনি ঘুমুচ্ছেন।
সূত্রের দাবি, গত ৩ জুন ঢাকা ত্যাগ করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সেদিন তারা ব্যাংককে যান। মির্জা ফখরুল এ প্রতিবেদকে তার ব্যাংকক যাত্রা চিকিৎসার কারণে বললেও সেখানে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে আমীর খসরুও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকটি ‘প্রিলিমিনারি’ ছিল বলে দাবি করেন আন্তর্জাতিক উইংয়ের একজন সদস্য। এরপরই আমীর খসরু ভারতে যান, যেখানে আগেই অবস্থান করছিলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং লন্ডন থেকে আসেন হুমায়ুন কবির। ভারত সফরে কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও বিএনপির নেতাদের সাক্ষাৎ হয়েছে—এমন দাবি রয়েছে কূটনৈতিক উইংয়ের। শনিবার রাতে বিএনপির মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন।
দ্য হিন্দু পত্রিকায় বলা হয়েছে— দিল্লিতে বিএনপি নেতারা বাংলাদেশের একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের সহায়তার জন্য মোদি সরকারের সহায়তা চেয়েছেন।
গত এপ্রিলে আমীর খসরু এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘ভারতের কোনও একটি পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক করে, তাহলে সেটা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হবে। কারণ, সম্পর্ক হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক। এখানে কোনও বিশেষ গ্রুপ বা দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক হলে বাংলাদেশের মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে।’
আন্তর্জাতিক উইংয়ের একাধিক সূত্র বলছে, বিএনপির তিন নেতার ভারত সফর হাইকমান্ডের সম্মতি নিয়ে হলেও দলের বিগত অবস্থান ভুল ছিল— সেটি বলার মধ্য দিয়ে রাজনীতিই শেষ হয়ে যায়। আমীর খসরুর নেতৃত্বে আরেকটি ‘তাইওয়ান-সংকট’ তৈরি হয় কী না, এ প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে দলের অভ্যন্তরে। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ঢাকায় তাইওয়ানের ট্রেড অফিস খোলাকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল (বিএনপির বিদেশনীতিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে চীন)। ওই সময় আমীর খসরু মাহমুদ বিএনপির বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন।
বিএনপির একজন ভাইস-চেয়ারম্যানের ভাষ্য, ‘সম্প্রতি সিইসি বলে দিয়েছেন আগামী নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে। এতে করে আমাদের ফিরতে হবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে। ওই নির্বাচন কাকে জেতানোর জন্য ছিল? বলে প্রশ্ন রাখেন এই সিনিয়র নেতা।
আন্তর্জাতিক উইংয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের মত, ‘আওয়ামী লীগকে রেখে ভারত কোনও দিনও বিএনপিকে ভোটে সমর্থন দেবে না। তারা কেয়ারটকারের পক্ষে নয়। বিএনপিকে বলবে, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাও। আমাদের যেতে হবে। আর গেলে কী হবে, হয়তো ষাটটি আসন পাবো। তো, ভারতের সহায়তা ছাড়া নির্বাচনে গেলে কি এর বেশি আসন পাবে না বিএনপি?’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, ‘ভারত সফরে বিএনপির তিন নেতার বক্তব্য, সংবাদপত্রে আসা খবরগুলো নিয়ে কমিটিতে আলোচনা হবে নিশ্চয়ই। এরপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে লিখিতভাবে জানানো হবে। তিনিই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।’
বিএনপির রাজনীতির পর্যবেক্ষক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপির নেতারা ভারত সফরে যেতেই পারেন। তবে নতজানু না হয়ে মাথা উঁচু করে তাদের সঙ্গে নেগোশিয়েট করতে হবে।ভারতকে বলতে হবে, আমাদের সৎভাই হিসেবে বিবেচনা না করতে। তাদেরকে বলতে হবে, ভূটান, নেপাল থেকে করিডোর সুবিধা দিতে হবে। রোহিঙ্গা বিষয়ে পরিষ্কার অবস্থান ব্যক্ত করতে।’