নিয়োগবিধি সংশোধনের অজুহাতে ভূমি প্রশাসনে দীর্ঘদিন ধরে আড়াই হাজার পদ শূন্য রয়েছে। নিয়োগ বন্ধ রয়েছে কানুনগো, সার্ভেয়ার ও চেইনম্যানসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে। এর ফলে প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন এক রকম অচল হয়ে পড়েছে। তহশিল ও এসিল্যান্ড অফিসগুলোতে দালালদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে।
শূন্যপদগুলোতে অলিখিতভাবে ঢুকে পড়ছে নানা শ্রেণীর দালাল। এতে দুর্নীতি ও জনহয়রানি আরও জেঁকে বসেছে। অভিযোগ উঠেছে, ভূমি সচিব আবদুল জলিল বিধি সংশোধনের কাজ দ্রুত ত্বরান্বিত না করায় সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
অপরদিকে মন্ত্রণালয়েও এখনও কাজের গতি ফেরেনি। ভুক্তভোগীদের অনেকে জানিয়েছেন, মাসের পর মাস ধরনা দিয়েও তারা আইনসঙ্গত ফাইল রিলিজ করতে পারছে না। এর ফলে মন্ত্রণালয়সহ সমগ্র ভূমি প্রশাসনে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
সূত্র জানায়, কানুনগো পদে মঞ্জুরিকৃত মোট পদের সংখ্যা ১ হাজার ৩৯৮টি। এর মধ্যে কর্মরত আছে ২৬১ জন। বাকি ১ হাজার ১৩৭টি পদে কয়েক বছর ধরে লোক নিয়োগ বন্ধ। সার্ভেয়ার পদ খালি আছে প্রায় দেড়শ’ জন। সহকারী তহশিলদারের পদেও শূন্যপদের ছড়াছড়ি অবস্থা।
চেইনম্যান পদে মঞ্জুরিকৃত মোট পদের সংখ্যা ১ হাজার ৭২৩টি। এর মধ্যে কর্মরত আছে ৯৭৭ জন। অবশিষ্ট ৭৪৬টি পদ শূন্য। ৬১টি ড্রাফটম্যান পদের মধ্যে ৩৭টি শূন্য। শুধু ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের অধীনে ৮টি পদে শূন্যপদের সংখ্যা প্রায় ৭শ’। এর মধ্যে ড্রাফটম্যান ১টি, ড্রাফটম্যান কাম এরিয়া এস্টিমেটর কাম সিটকিপার ২১৬টি, বাউন্ডারি আমিন ৫টি, সার্ভেয়ার ১৫০টি, সাব সার্ভেয়ার ১০টি, কম্পিউটার অপারেটর ১৮টি, ট্রাভার্স সার্ভেয়ার ৮টি, চেইনম্যান ৮১টি এবং চেইনম্যানের আউটসোর্সিং পদে আরও ২শ’টি পদ শূন্য আছে।
ভূমি প্রশাসনে কর্মরত বেশ কয়েকজন এসিল্যান্ড ও কানুনগো জানান, এভাবে বছরের পর বছর পদ শূন্য থাকায় মাঠ পর্যায়ে তাদের প্রতিটি কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো কাজই তারা সময়মতো শেষ করতে পারছেন না।
একজন কানুনগো দিয়ে আশপাশের ২-৩টি উপজেলাতেও দায়িত্ব পালন করার নজির রয়েছে। প্রয়োজনীয় লোকবল ছাড়াও কম্পিউটারের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আছে দক্ষ জনবলের প্রবল সংকট। এ রকম নানামুখী সমস্যার কারণে তারা অনেক সময় সময়মতো নামজারি কেস নিষ্পত্তি করতে পারেন না।
তারা জানান, এই বাস্তবতায় স্থানীয় দালাল চক্র এসব অফিসে জায়গা করে নিয়েছে। চা খাওয়ানোর পিয়নসহ ভূমি অফিসের ফাইলপত্রের নানা কাজের দক্ষ সঙ্গী এখন এসব দালাল। এতে প্রশাসনের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। বাড়ছে অনিয়ম-দুর্নীতি। দালালদের খপ্পরে পড়ে কর্মকর্তাদের অনেকে চাকরিজীবনের শুরুতে দুর্নীতির খাতায় নাম লেখাচ্ছেন।
ক্ষোভের সঙ্গে তারা বলেন, শুনেছি বারবার নিয়োগবিধি সংশোধনের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা আর সামনে এগোতে পারে না। এছাড়া দীর্ঘদিন নিয়োগ বন্ধ থাকায় এর মধ্যে মামলা-মোকদ্দমার জটিলতাও ভর করেছে।
আবার উচ্চ আদালত রায় দেয়ার পরও নিয়োগ না দেয়ার নজির তৈরি হয়েছে। তারা মনে করেন, হয় দ্রুত নিয়োগবিধি সংশোধন করতে হবে, নতুবা বিদ্যমান নিয়োগবিধিতে নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে ভূমি প্রশাসন আরও মুখ থুবড়ে পড়বে। এতে করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
বিশেষ করে নির্বাচনের বছরে যারা এসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে নিয়োগ আটকে রেখেছেন তারা আর যাই কিছু হোক, কোনোভাবে সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারেন না।
নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র জানায়, ভূমি মন্ত্রণালয়ে গত এক বছর ধরে কত ফাইল পেন্ডিং আছে শুধু যদি এই হিসাব বের করা হয় তাহলে মন্ত্রণালয়ের কাজের গতির আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দ্রুত কাজ নিষ্পত্তির জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মসম্পাদন চুক্তি করছে।
সেখানে খাতাপত্রে নানা ছক কষে মান নির্ধারণের কত ফর্মুলা না আবিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু ফাইল নিষ্পত্তির হিসাব সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সেখানে ঠাঁই পায়নি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ছকে দেখানো হয়েছে কাজের মোট সূচক ৭৯টি। এর মধ্যে অসাধারণ কাজ নাকি হয়েছে ৩১টি! ১টি অতিউত্তম, ১টি উত্তম, সন্তোষজনক নয় ১০টি, আর অর্জিত হয়নি ৩২টি।
ভুক্তভোগীরা মনে করেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রতি মাসে কতটি নতুন ফাইল ও চিঠি/আবেদন উপস্থাপন করা হয় এবং তার সর্বশেষ অবস্থা কী সবার আগে সেটি বের করা দরকার। জনস্বার্থে সোজা এই হিসাবটা আগে বের করা হলে অনেকের মুখোশ উন্মোচিত হবে।
তাই উচিত হবে, ৩ মাস অন্তর কতটি ফাইল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং কতটি কী কারণে হয়নি সে পরিসংখ্যান বের করা। তাহলে দেখা যাবে, কীভাবে শত শত ফাইলের সঙ্গে সেবাপ্রার্থীরা চরকির মতো দিনের পর দিন ঘুরছেন। তখন সরকারের নীতিনির্ধারক মহল প্রকৃত অর্থে কথিত দলবাজ আমলাদের মূল্যায়নের সুযোগ পাবে। তা না হলে প্রকৃত তথ্য ও অবস্থা কোনোদিন জানা যাবে না।
সবাই নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকবেন। কোথায় কাকে বেশি খুশি রাখতে পারলে প্রাইজপোস্টিং পাওয়া যাবে, নিয়মিত চাকরির মেয়াদ শেষে পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ মিলবে সে প্রতিযোগিতা বাড়বে বৈ কমবে না।