সহুল আহমেদ মুন্নাঃ শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে লিখিত শহিদুল আলমের প্রবন্ধ নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের আটাশে ফেব্রুয়ারি। সে আর্টিকেলের মূল ছবিতে লেখা ছিল, ‘আমরা বিচার চাই’। কাকতালীয়ভাবে দেখা যাচ্ছে ঠিক পাঁচবছর পরে যে আন্দোলন সম্পর্কে কথা বলার জন্যে শাহিদুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে সে আন্দোলনের স্লোগানও ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ (আমরা বিচার চাই)! সরলীকরণ হয়ে গেলেও সত্যি যে এটা আমাদের ভঙ্গুর বিচার ব্যবস্থার অস্ত্বিত্বের জানান ও প্রমাণ দেয়। আলাপ না বাড়িয়ে পাঁচ বছর আগে সেই প্রবন্ধে শাহিদুল আসলে কি লিখেছিলেন, আসুন সেটা একবার দেখে নেই। একেবারে শব্দের সাথে শব্দ মিলিয়ে অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ করেছি।
‘গত মাসে ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে হাজার হাজার বাংলাদেশী শাহবাগ মোড়ে জমায়েত হয়।
সাধারণ জনগণ – দাদার বয়সী মানুষ থেকে শুরু করে, হুইলচেয়ারে বসে থাকা লোকটা, দাড়িওয়ালা লোকটা, হিজাবওয়ালা মেয়েটা, জিন্স পরা টিনেজার পর্যন্ত – সবাই জড়ো হয়েছে রাজপথে যেমন রাগে, তেমনি আনন্দে। বাচ্চারাও আসছে তাঁদের প্রিয় পোশাক পরে, বাপ-মায়ের কাঁধে চড়ে, না বুঝেই স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। কোন ধরণের হয়রানীর শিকার না হয়েও নারীরা নিরাপদে অংশগ্রহণ করছে।
একাত্তর বাংলাদেশের জন্মের বছর। ৪৭’র দেশভাগের পর থেকেই আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলাম। একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী, চীন ও মার্কিনদের সাহায্যে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লক্ষ-লক্ষ মানুষ মারা যায়, এবং ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
জামায়াতই ইসলামী তখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগী হিসেবে কাজ করে। তারা ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন সহ সকল ধরণের অপকর্মে লিপ্ত ছিল। তারা শত শত বুদ্ধিজীবীদেরকে টার্গেট করে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে।
ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন সরকার এইসব রাজাকার, দালালদের বিচারের ওয়াদা করে। আমরা সকলেই জানতাম এরা কারা। কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবেশী দ্বারা বেষ্টিত একটি নতুন রাষ্ট্রকে চরম বাস্তবতা মেনে নিয়েই আপোষ করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষ আদালত গঠনও করেছিলেন। হাজার হাজার অভিযোগও দাখিল হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭৩ সালের শেষের দিকের শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে এই বিচার দীর্ঘায়ত হয়। বছর দুয়েক পরে তিনি নিহত হন, এবং একের পর এক সামরিক ক্যু হতে থাকে।
বাংলাদেশের মূল সংবিধান চারটা মূলমন্ত্র নিয়ে গঠিত: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সামরিক শাসকরা ১৯৭৭ সালে এইটা পরিবর্তন করে ‘আল্লাহ্র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে সকল কার্যাবলীর ভিত্তি’ যুক্ত করেন এবং ১৯৮৮ সালে আরেকবার পরিবর্তন করে আমাদের এ সেকুলার রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে দেন। মার্শাল ল’, সাধারণ ক্ষমা, রাজনৈতিক সমঝোতা জামায়াতকে ধীরে ধীরে রাজনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনে।
এই ২০১০ সালে শেষপর্যন্ত এদের বিচার করার জন্যে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। প্রথম রায় দেয়া হয় গত মাসে, জামায়াত নেতা আবুল কালাম আজাদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। দ্বিতীয় রায়ে, ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ, জামায়াতের আরেক নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা কিনা আন্দোলনকারীর মতে খুবই সহনশীল। আন্দোলনকারীরা সন্দেহ পোষণ করে যে, এই সহনশীল শাস্তি (যাবজ্জীবন) ইসলামিস্ট নেতাদের সাথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গোপন আঁতাতের ফল।
জামায়াত বি এন পির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটে অন্তর্ভুক্ত। এই ভয়ও আছে যে, যদি নতুন কোন সরকার ক্ষমতায় আসে তাহলে এরা যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দিবে। অন্যদিকে বর্তমান সরকারও ভয়ংকর নজির স্থাপন করেছে: ২০০৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত হাসিনা সরকার প্রায় ২০ জন ফাঁসির আসামীকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
শাহবাগের এই তরুণ আন্দোলনকারীদের কখনো দখলদারিত্বের মধ্যে, ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ভয়ে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা হয় নাই। কিন্তু তারা সকলেই সরকারের দ্বিচারিতা নিয়ে রাগান্বিত।
বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে বাংলাদেশের সরকার সকল বিশ্বাস হারিয়েছে। জনগণ মনে করে ব্যবস্থা এতটাই দূষিত হয়ে গিয়েছে যে, নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব না। তাই, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ আহমেদ রাজিব হায়দার (ব্লগার, আন্দোলনের একজন আয়োজক) নিহত হন। তার গলা কেটে ফেলা হয়, শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয় – যা কিনা জামায়াতে ইসলামের ট্রেডমার্ক। আন্দোলনকারীরা ফুঁসছিল রাগে ও শোকে, কিন্তু শাহবাগ প্রতিশোধের উন্মত্ততায় পরিণত হয় নাই। সেখানে অনেকেই ছিলেন যাদের কাছে চোখের বদলে চোখই ছিল একমাত্র উত্তর। কিন্তু, সেই সাথে আরেকটা ছোটখাটো ভিড়ও ছিল- যারা প্রস্তুত ছিল প্রতিরোধের জন্যে, অন্ধ অনুকরণের জন্যে নয়।
এর পর থেকে সহিংসতা বেড়েই চলছে। বৃহস্পতিবার, জামায়াতের আরেক নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদির রায়ের পর শাহবাগের আন্দোলনকারীরা আনন্দ প্রকাশ করে। অন্যদিকে জামায়াত নেতারা সহিংস উপায়ে এর প্রতিশোধ নিতে দেশব্যাপী রক্তাক্ত সংঘর্ষের সূচনা করেন।
তরুণ বাচ্চারা যে কোন বিচারকেই অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। এবং, জনপ্রিয়তার চাপে কোন আদালতকে রায় পরিবর্তনে বাধ্য করাও উচিৎ না।
কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনকে শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে আন্দোলন এই চেহারায় দেখা উচিৎ হবে না। এখানে একটা গণতন্ত্রী আকাঙ্ক্ষাও আছে। এদের দাবি হচ্ছে শেষ পর্যন্ত বিচার করতে হবে। এটা জাতিকে ঐসব নেতাদের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা যারা ব্যক্তিগত চাহিদার জন্যে বারেবারে ‘জাতীয় আকাঙ্ক্ষা’কে বিসর্জন দিয়েছেন। আন্দোলনকারীরা একাত্তরের চেতনাকে বহন করছেন – এবং, বর্তমানে এটাই বড় যুদ্ধ যেখানে এখনো আমাদের জিততে হবে।‘
২
শাহবাগ আন্দোলন চলাকালীন সময়েই এই প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধী, জামায়াতই ইসলামী এসব নিয়ে শাহিদুল আলমের মনোভাব কেমন সেটা তার এই ছোট্ট লেখাই প্রমাণ দেয়। কিন্তু আমার মূল উদ্দেশ্য এইটা বলা না, প্রমাণ করাও না। বরং প্রোপাগান্ডিস্টদের কাজের দিকে চোখ ফিরানো। প্রোপাগান্ডিস্টরা বিভিন্ন রঙয়ের বোতলে ভর্তি তেলের মতো। তাঁদের চরিত্র একই রকম, কিন্তু প্রচ্ছদ আলাদা। এরা সবাই বিমানবীকরণে ওস্তাদ, সেটা যেমন বাঁশের কেল্লা করে, তেমনি সরকারবাদী প্রোপাগান্ডিস্টরাও করেন। বাঁশের কেল্লা ইচ্ছেমতো নাস্তিক বানায়, আর আওয়ামী প্রোপাগাণ্ডা যন্ত্র ইচ্ছেমতো রাজাকার বানায়। দুই গ্রুপই ডিহিউম্যানাইজ করে ব্যক্তিকে।
সরকার শাহিদুল আলমকে গ্রেফতার করেছে। কেন গ্রেফতার করেছে এই প্রশ্ন এড়িয়ে সরকারী প্রোপাগান্ডিস্টারা শাহিদুল আলমকে রাজাকার বানাতে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। তাদের মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে শাহিদুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে এই ‘রাজাকারী’র কারণে! বাদবাকী সবাই হাঁটুভেঙে নেমেছেন এইটা প্রমাণ করতে যে তিনি রাজাকার না। সবাই সরকারাদী প্রোপাগান্ডিস্টদের চক্করেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। এমনকি আমিও। কিন্তু যে মৌলিক প্রশ্ন চাপা পড়ে যাচ্ছে সেটা হচ্ছে তাকে কেন গ্রেফতার করা হলো। যে সাক্ষাৎকারের জন্যে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেখানে তিনি আসলে বলেছিলেন? তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল এই আন্দোলন নিয়ে, এর কারণসমূহ নিয়ে। তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অনেক গভীরে আলাপ নিয়ে গিয়েছেন। তিনি শুরুতেই বলছেন, এই সরকার ‘অবৈধ’, কারণ তারা জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই ক্ষমতায় এসেছে। এরপর তিনি একে একে ব্যাংকিং খাতের লুটপাট, শিক্ষাখাতে দূর্নীতি, গুম, বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উপর সরকারী বাহিনীর দমন-পীড়ন এসবের কথা তুলে এনেছেন। তিনি বলছেন যে মানুষ এসব কারণে ফুঁসছে, এবং এই কারণে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সবদিকে।
সরকার বলছে শাহিদুল আলম গুজব রটাচ্ছেন, কিন্তু তিনি যে পয়েন্টগুলো তুলে এনেছেন সেটার একটাও কি গুজব? ব্যাংকিং খাতে চোখ ফেরালে দেখবেন ঋণ খেলাপীর পরিমাণ ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। দেখবেন কিভাবে ব্যাংক ডুবিয়ে জাহাজ ভাসছে। শিক্ষাক্ষেত্রে আসলে দেখবেন কিভাবে পঞ্চম শ্রেণি থেকে শুরু করে একেবারে চাকরির পরীক্ষাতেও প্রশ্ন ফাস হচ্ছে। টাকা দিয়ে অমূল্য জিপি-এ ফাইভ কেনা হচ্ছে। আর বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড তো পুরনো কিছু না, এখনো চলছে। প্রায় দেড়শর অধিক মানুষ মারা গিয়েছেন। কোটা সংস্কারের আন্দোলন এখনো চলছে। হাতুড়ির দিয়ে ছাত্র মারার ছবি এখনো আমাদের চোখে সজীব। আহতদের হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়ার সংবাদ এখনো জীবিত। এইসবই যদি সত্যি হয়ে থাকে তাইলে গুজবটা কই?
এখানে আসলে সরকারবাদী প্রোপাগান্ডিস্টরা সফল হচ্ছেন। ‘গুজব’ আলোচনা তুলে তারা ঢেকে দিতে চেয়েছিলেন লীগ-পুলিশের নির্মম আক্রমণকে, শতাধিক আহত ছাত্রকে। এখন শাহিদুল আলমের ‘রাজাকার’ তর্ক দিয়ে লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছেন তার গ্রেফতারের আসল কারণ। তার সাক্ষাতকারে ফুটে উঠা নির্মম সত্য কথা! সেই সাথে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গ্রেফতার কাহিনী। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র এদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী নিয়ে, এই ছাত্ররা দাঁত কিড়িমিড়ি করে প্রতিরোধ করেছে, অথচ, এদের এখন জেলে পুরে রাখা হচ্ছে, থানায় নির্যাতন করা হচ্ছে, এর চেয়ে বড় লজ্জার কথা আর কি হতে পারে?
এদের সবাইকে মুক্ত করতেই হবে।
এই প্রোপাগান্ডিস্টদের কাছ থেকে যত দূরে থাকবেন তত মঙ্গল হবে, মস্তিষ্কের বিকাশ ততই বেশি হবে। যাই হোক, ঘুরে ফিরে, আমরা বারে বারে একই আলোচনায় ফিরে আসছি, এবং সেটা হচ্ছে, আমরা বিচার চাই। উই ওয়ান্ট জাস্টিস! শাহিদুল আলমের ঐ প্রবন্ধের শেষ লাইনের মতো করে বলি, – ‘বর্তমানে এটাই বড় যুদ্ধ যেখানে এখনো আমাদের জিততে হবে।‘