বিস্ময় ও হতাশায় বিমূঢ় বিএনপি। সর্বোচ্চ আদালতে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন না মেলায় আশাভঙ্গের বেদনায় কাতর সর্বস্তরের নেতাকর্মী। দীর্ঘ এই আইনি লড়াই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় এখন চেয়ারপারসনের মুক্তির জন্য আন্দোলন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তাদের সামনে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের পর প্রায় দু’বছরেও তেমন জোরালো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। এখন তার মুক্তির জন্য আরও কঠোর কর্মসূচি নিয়ে কীভাবে মাঠে নামবে, সেটা দলের জন্য অগ্নিপরীক্ষা হয়ে দেখা দিয়েছে। এক কঠিন বাস্তবতাকে সামনে রেখে আগামী ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের পর ধাপে ধাপে শক্ত কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে বিএনপি।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সার্বিক আন্দোলনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তবে একই সঙ্গে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পথও খুঁজবে তারা। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আপিল বিভাগের রায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলের নেতাদের অনেকেই খালেদা জিয়ার জামিন না হলে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে কঠোর আন্দোলনের কথা বলে যাচ্ছিলেন। সেগুলোর অনেকখানিই সরকারকে চাপের মুখে রাখতে। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। সার্বিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নানা কৌশলী কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এখনই সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের মতো সিদ্ধান্তে যাবেন না তারা। এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি দেওয়া হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও মহান বিজয় দিবসের পর পরই এসব কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবেন নেতাকর্মীরা। প্রাথমিকভাবে আগামী রোববার দেশব্যাপী সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত না থাকলেও গতকাল তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন নেতাকর্মীরা। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের পর রাজধানীতে মহাসমাবেশের ডাক দেবে দলটি।
সূত্র জানায়, প্রথমে বিএনপি এককভাবে কর্মসূচি পালন করবে। একই সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটকে আন্দোলনে যুক্ত করতে এরই মধ্যে জোট দুটির সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছেন শীর্ষ নেতারা। চলতি শীত মৌসুমে বড় ধরনের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারকে চাপে ফেলে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার চেষ্টা করবে বিএনপি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেছেন, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে তারা বিস্মিত ও হতবাক। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অসুস্থতার ব্যাপারে সামান্যতম মানবিকতা স্থান পায়নি। তার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিবেদনেও প্রকৃত চিত্র নেই। এ পরিস্থিতিতে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসনকে মুক্ত করতে যা যা দরকার তার সবই করবেন তারা।
খালেদা জিয়ার জামিনের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। মানবিক বিবেচনায় উচ্চ আদালতে তিনি জামিন পেতে পারেন বলে নানা গুঞ্জনও ছিল। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের কথাবার্তায়ও এমন আশাবাদ প্রকাশ পাচ্ছিল। তবে গত ২৮ নভেম্বর খালেদা জিয়ার জামিনের শুনানিতে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিবেদন জমা না পড়ায় কিছুটা হোঁচট খান নেতাকর্মীরা। গতকাল পরিবর্তিত শুনানির দিনে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ায় তারা কার্যত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন।
এ পরিস্থিতিতে কী করবে বিএনপি- এ প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দলের নেতাকর্মীসহ রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের মনে। উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই ‘আপাতত’ শেষ। এখন খালেদা জিয়া কি প্যারোলে মুক্তি চাইবেন, নাকি রাষ্ট্রপতির কাছে সাজা মওকুফের আবেদন করবেন? আবার এ দুটি পথে গেলে রাজনৈতিকভাবে ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেক নেতাকর্মী। অবশ্য গতকাল সুপ্রিম কোর্টে জামিন শুনানির আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়াও প্যারোলে মুক্তি বা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে রাজি ছিলেন না। জামিন নাকচ করার পর তার সিদ্ধান্ত বদলাবে কি-না, তা সময় বলে দেবে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেছেন, প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তির আবেদন করার প্রশ্নই আসে না। আর কোনো আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে কি-না, এমন প্রশ্নে বিএনপি চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা ও তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যতদিন আইনজীবীরা আছেন, ততদিন আইনি প্রক্রিয়াও থাকবে। দেখেন, কী হয়। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন আমাদেরকে বলেন, তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাদের ধারণার বাইরে গিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছেন।
বিএনপি নেতাকর্মীদের মতে, ‘আপসহীন’ নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার আলাদা ইমেজ রয়েছে। তিনি ‘৮৬ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের সঙ্গে আপস করে নির্বাচনে যাননি। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও কোনো প্রকার ‘সমঝোতা’ করতে রাজি হননি। দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য তিনি বরাবরই ত্যাগ স্বীকার করে আসছেন। আগামীতে এর ব্যত্যয় ঘটবে না বলে তাদের বিশ্বাস।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের প্রতিবেদককে বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ প্রশাসনিক আদেশের শামিল। এটা হতাশাজনক।
এদিকে আদালতে খালেদা জিয়ার মেডিকেল রিপোর্ট ভুলভাবে উপস্থাপন করা হবে বলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের আগাম মন্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, তাদের পছন্দমতো রিপোর্ট যেটি হবে না, সেটাই ভুল হবে। আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। সর্বোচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেটাই আমাদের মেনে নিতে হবে।