ধর্মভীরু তরুণ-তরুণীদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা। তাদের মুল উদ্দেশ্য ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করা। তারা চায় না কেউ তাদের মতের বিরুদ্ধে যাক এবং ইসলামের বিপক্ষে কোন কার্যক্রম পরিচালনা করুক। তারা মূলত টার্গেট করে থাকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, বিশেষ করে ব্লগারদের, যারা ‘তাদের মতে’ ইসলামের বিরুদ্ধে যায় এমন বিষয় নিয়ে লিখালিখি করে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা গোপনে ব্লগারদের নতুন হিটলিস্ট তৈরি করছিল এবং তাদেরকে একে একে হত্যা করার পরিকল্পনাও করছিল। এছাড়া নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটি দেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের দেশ থেকে বিতাড়িত কিংবা ধর্মান্তরিত করে বাংলাদেশকে একটি সহি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনা করছিল। তারা নাশকতার জন্য দেশের বাইরে থেকে অস্ত্র সংগ্রহের কাজও করছিল। গোপন খবরে পৃথক দুইটি অভিযানে তাদের ছয় জন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব এসব তথ্য পেয়েছে।
শনিবার (১৮ জানুয়ারি) বিকেলে জাগোবাংলা২৪-কে এসব তথ্য জানান র্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ফারুকী। তিনি জানান, গতকাল শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) রাতে পাবনায় পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হলো- সাকিব আল ইমতিহান, আব্দুল ফাতেহ, গিয়াস উদ্দিন, নাজমুস সাদাত ফাহিম, মিনহাজুর রহমান ও হাবিব উল্ল্যাহ। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে ৪৪টি উগ্রবাদী বই, ৮৩ জন ব্লগারের নাম সম্বলিত হিট লিস্ট, জঙ্গি প্রশিক্ষণের ট্রেনিং ম্যানুয়েলসহ বিভিন্ন ধরনের উস্কানিমূলক লিফলেট।
তিনি জানান, গত ১৬ নভেম্বর ও ৬ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ ও সিলেটে পৃথক অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের আত্মঘাতী দলের চার সদস্যকে আটক করা হয়। তাদের কাছে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব বাকি সদস্যদের ধরতে মাঠে নামে। শুক্রবার রাতে ও শনিবার ভোরে পাবনার চরঘোষপুর ও নিউমার্কেট এলাকায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা আনসার আল ইসলামের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
মহিউদ্দিন ফারুকী আরও জানান, জঙ্গিরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করতে ধর্মভীরু সহজ-সরল যুবতীদের টার্গেট করে বড় ধরণের নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল। এছাড়া ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ও ফেসবুকে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ খুলে সদস্য বাড়ানোর কাজও করতো।
গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপক্ষে তারা ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। তাদের মতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বাতিল। তাই ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠায় যারা প্রতিহত বা বিরাধ সৃষ্টি করে তাদের চূড়ান্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতেই তারা টার্গেট কিলিং মিশনের পরিকল্পনা করেছিল।
তিনি আরো বলেন, তাদের মতে দেশের প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করাই আনসার আল ইসলামের মূল উদ্দেশ্য। তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতাকারীদের উপর তারা আকস্মিক আক্রমন করে কঠোর শাস্তি বা টার্গেট কিলিং করে থাকে। টার্গেট কিলিং এর ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় আগ্নেয়াস্ত্রের পরিবর্তে চাপাতি ব্যবহার করে। জঙ্গি তৎপরতা, প্রশিক্ষণ ও করনীয় সম্পর্কে তারা Protective Apps, Protective Text, Protective Browser এর মাধ্যমে যোগাযোগ করে। এর মাধ্যমেই তারা নাশকতার পরিকল্পনা করত। যে কারণে তাদেরকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন ছিল। এরইমধ্যে তারা একটি বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল। যা গ্রেফতার করার কারণে নস্যাৎ হয়ে গেছে। তবে কী ধরনের পরিকল্পনা ছিল সেটি তদন্তের স্বার্থে এখনই বলা যাচ্ছে না। অভিযানের সময় তাদের বেশ কয়েকজন সদস্য পালিয়ে গেছে। তাদেরকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তাদের সকলকে আইনের আওতায় আনার পর এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানানো হবে।
মহিউদ্দিন ফারুকী আরও জানান, গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের কাছ থেকে ৮৩ জন ব্লগারের নাম সম্বলিত একটি হিটলিস্ট জব্দ করেন র্যাব-২ এর একটি চৌকস অনুসন্ধানী দল। জব্দকৃত এই হিটলিস্টে রয়েছে মূলত বাংলাদেশ ও প্রবাসে থাকা বিভিন্ন ব্লগারদের নাম, তাছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সাংবাদিক, লেখক ও প্রকাশকদের নাম। তালিকায় থাকা ৮৩ জনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনঃ ডঃ মোঃ জাফর ইকবাল, অমি রহমান পিয়াল, আরিফ জেবতিক, ইমরান এইচ সরকার, সুব্রত শুভ, আরিফুর রহমান, সোহাগ শংকরী, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, খায়রুল্লা খন্দকার, দাউদ হায়দার, টনি এন্ড্রু গোমেজ, তসলিমা নাসরিন, আসিফ মহিউদ্দিন, জয় বিশ্বাস, তানজিলা তাজ রিসা, দাঁড়িপাল্লা ধমাধম, আশিস চ্যাটার্জি, এমডি সাইফুর রহমান, আসমা জেরিন, রাসেল পারভেজ, ওমর ফারুক লুক্স, অরুনাংশু চক্রবর্তী, সৈকত চৌধুরী, আউটসাইডার, চিন্ময় দেবনাথ, অনিরুদ্ধ কর্মকার, প্রণব আচার্য, ভেরোনিকা গোমেজ, অনন্য আজাদ, আসাদ নূর, তুরিন আফরোজ, পারভেজ আলম, সোজাকোথা, মনির হাসান, শাহেদ আলম, প্রমুখ।
উল্লেখ্য যে, এর আগেও বিগত কয়েক বছরে আনসার আল ইসলাম এর বেশ কিছু জঙ্গি গ্রেফতার করা হয় এবং গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের কাছ থেকে ব্লগারদের নাম সম্বলিত হিটলিস্ট উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হিটলিস্ট-এর তালিকাভুক্ত ব্লগারদের মধ্যে রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, নিলয় নীল, আরিফ রায়হান দ্বীপ, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, ফয়সাল আরেফিন দীপন, অর্ঘ্য বোস, সাফিউল ইসলাম, সানাউর রহমান, নাজিমুদ্দিন সামাদ, আশরাফুল আলম, আহমুদা আক্তার, শাহজাহান বাচ্চু সহ আরও অনেক ব্লগার নির্মমভাবে নিহত হোন, এবং হত্যার পরবর্তীতে আনসার আল ইসলাম এসকল হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেন।