ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নানা অনিয়ম ঘটছে। বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। একশ্রেণির গ্রাহক ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে ঋণের নামে ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকায় বাড়ছে ননপারফর্মিং লোন বা এনপিএল। আর খারাপ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া পর্যবেক্ষকরা ঐসব প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। পর্যবেক্ষকরা পর্যবেক্ষণই করে যাচ্ছেন। নিচ্ছেন না কোনো পদক্ষেপ।
কোনো ব্যাংকের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে বা খারাপ অবস্থায় চলে গেলে, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ঐ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইভাবে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও (এনবিএফআই) পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী পর্যবেক্ষক ব্যাংকের পর্ষদ, নির্বাহী ও নিরীক্ষা কমিটির সভায় অংশ নেন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাইবাছাই করে দেখেন। কোনো আপত্তি থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে মতামত দেন তারা।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয় সরকারি ব্যাংকগুলোতে। সরকারি ব্যাংকের কোনো কাজে তেমন বেশি হস্তক্ষেপও করতে পারে না বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিতে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে বেসরকারি ব্যাংকেরও দেওয়া হয় পর্যবেক্ষক। অবশ্য দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে প্রথম পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় ১৯৯৪ সালে। সেসময় ওরিয়েন্টাল ব্যাংককে রক্ষার চেষ্টা করা হয়। পরে অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। এরপর বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকে দেওয়া হয় পর্যবেক্ষক। তাতেও ঐ ব্যাংকের পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়নি। সরকারি ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক থাকার পরও একের পর এক অঘটন ঘটছে। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফারমার্স ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে লাভ হয়নি। পরে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তনসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব বিবেচনায় পর্যবেক্ষকরা ব্যাংকের যে খুব বেশি উন্নতি করতে পেরেছেন তার নজির নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকও আর্থিক খাত সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলে মনে করছেন আদালত। সম্প্রতি এক আদেশে হাইকোর্ট বলেছে, আমাদের দেশের জনগণের জন্য দুর্ভাগ্য যে, যেখানে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি-উন্নয়নের জন্য সরকার প্রধান ক্লান্তিহীন কাজ করে যাচ্ছেন, সেখানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিশেষ করে ডিজিএম, জিএম, নির্বাহী পরিচালক ও ডেপুটি গভর্নররা ঠগবাজ, প্রতারক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। শুধু ব্যক্তিস্বার্থে তারা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১১টি ব্যাংক ও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষক দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বাবদ প্রত্যেককে মাসিক ২৫ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হয়। প্রত্যেক পর্যবেক্ষকের জন্য দুজন করে সহযোগী রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের সম্মানী আট হাজার টাকা করে। সে হিসাবে পর্যবেক্ষক বাবদ বাংলাদেশ ব্যাংককে বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। অন্যদিকে যারা পর্যবেক্ষক হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই ঐ ব্যাংক থেকে সুবিধা নিচ্ছেন। চাকরি দেওয়া থেকে ঋণ ব্যবস্থাপনার অনেক কাজও করছেন অনেকে। আর কেউ কেউ তো বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি শেষে যাতে ঐ ব্যাংকে চাকরি পাওয়া যায় তারও ব্যবস্থা করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ঐসব ব্যাংকে যোগ দেওয়ার উদাহরণ অনেক আছে। এসব অবৈধ সুবিধা নেওয়ার ফলে মূলত ব্যাংকগুলোর বিপক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে ব্যাংককে সহযোগিতা করেন অনেক পর্যবেক্ষক। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা বলছেন, আইনগত কিছু সীমাবদ্ধতার কারণেও অনিয়ম করা ব্যাংকের বিপক্ষে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না পর্যবেক্ষকরা।
বর্তমানে যে ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক রয়েছেন সেগুলো হলো—রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংক এবং ব্যক্তি খাতের ন্যাশনাল, পদ্মা, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকে।
পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলোতে নিয়োগকৃত পর্যবেক্ষকরা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করছেন। তারা বোর্ডসভায় থেকে সব বিষয়ের খোঁজ রাখার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ব্যাংকগুলোকে পরিচালিত করার চেষ্টা করছেন। ফাইলপত্র যাচাইবাছাইয়ের কাজও করছেন তারা। বোর্ডে একজন পর্যবেক্ষক আছেন, এটা ঐ বোর্ড সদস্যদের জন্য একটি মানসিক প্রস্তুতিরও বিষয় থাকে। এতে ব্যাংকগুলো সবকিছু সঠিকভাবে করার চেষ্টা করে। অবশ্য এর পরও কিছু অন্যায়-অনিয়ম হচ্ছে। সিরাজুল ইসলাম নিজেও রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের পর্যবেক্ষক। ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক না থাকলে আরো খারাপ অবস্থা হতে পারতো বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।