বিপ্লবের পরিসমাপ্তি খুব খারাপভাবে ঘটে। আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ক্ষমতা থেকে বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা উৎখাত হয়েছেন। এরপর দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বদানকারী ক্ষুদ্রঋণের প্রবর্তক ও শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ও হত্যার নির্দেশ দেওয়া শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সদস্যরা তাদের কর্মস্থল ছেড়ে গিয়েছিলেন। সেই পুলিশের বেশির ভাগ সদস্যই আবার তাদের দায়িত্বে ফিরেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আর পতনের মুখে নেই। জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা ৫ ভাগই আসে রেমিট্যান্স থেকে। সেই রেমিট্যান্স এখন স্থিতিশীল। এরপরও সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ কীভাবে মোকাবিলা করবে সেই প্রভাব কেবল দেশের ১৭ কোটি ৩০ লাখ জনগোষ্ঠী নয়, এর প্রতিবেশীর ওপরও পড়বে। ভারত, চীন এবং পশ্চিমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপরও এর প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা, নির্বাচন ইত্যাদি ইস্যুতে ‘আফটার দ্য রেভ্যুলেশন, বাংলাদেশ ইজ স্ট্যাবল. ফর দ্য মোমেন্ট’ শিরোনামে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এভাবেই লিখেছে লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পরিস্থিতি অনুযায়ী নাজুক হলেও ড. ইউনূস এমন একটি সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনুমোদন করে এমন একটি সাংবিধানিক ধারাকে ২০১১ সালে শেখ হাসিনা বাতিল করে দিয়েছেন। সুতরাং ড. ইউনূসের বৈধতা নির্ভর করছে তার নৈতিক কর্তৃত্ব ও জনপ্রিয়তার ওপর। কোনো ভোটের মাধ্যমে এর সমর্থন আদায় করা হয়নি বলে এর ভিত্তি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। জনগণের সদিচ্ছা ‘প্রশমিত’ হতে পারে। অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও অক্টোবরে গত বছরের তুলনায় খাদ্যে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ। বাংলাদেশে বিদ্যুতের শতকরা প্রায় ১০ ভাগ সরবরাহকারী ভারতের আদানি গ্রুপ বকেয়া পরিশোধের কথা জানিয়ে সরবরাহ কমানো শুরু করেছে। বন্যার কারণে ধানের উৎপাদনও ব্যাহত হয়েছে।
প্রশাসনিক বিবেচনায় ড. ইউনূস বেশ দুর্বল। সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা তার নেই। দুই পক্ষের চাপে তিনি চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছেন। যেসব আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী তাকে ক্ষমতায় আসার পালে হাওয়া দিয়েছে তারাই এখন একের পর এক চরম সব দাবি তুলে ধরছেন। এসব দাবির মধ্যে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিও রয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করতে ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে তারা প্রত্যর্পণ চাইছে। বাংলাদেশে আরেক শক্তি হলো আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তারা ড. ইউনূসের কাছে জুনের মধ্যেই দ্রুত নির্বাচন দাবি করছে। তিনি নির্বাচন না দেওয়া পর্যন্ত তারা গণবিক্ষোভ চালিয়ে যেতে পারে।
উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টিরও আশঙ্কা রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতি ড. ইউনূসের সহনশীলতা দেখে হতাশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আবার রাজপথ বেছে নিতে পারে। এ সময় সহিংসতার হুমকিও রয়েছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস থাকা বাংলাদেশের জন্য এমন পরিস্থিতি সত্যিই ভয়াবহ উদ্বেগের। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাদের অনেকে আওয়ামী লীগ সমর্থকও রয়েছেন। এরই মধ্যে তাদের ওপর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
উদ্বেগের আরেকটি বিষয় হলো-ক্ষয়ে যাওয়া বিচারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য যে সময় প্রয়োজন তার আগেই বিএনপির দাবির কাছে ড. ইউনূসের আত্মসমর্পণ এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। বিএনপি যদি ত্রুটিপূর্ণ, অপরিণত নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করে, তাহলে এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সেই পেশিশক্তি আর গোষ্ঠী শাসনের পুরোনো ধারার ক্ষমতার পালাবদলের প্যাটার্ন ফিরতে পারে।
ইকোনমিস্ট প্রতিবেদনে বলছে, এ পরিস্থিতিতে কী করা যেতে পারে? বিশ্ব যখন প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন খুব কম সরকারের কাছেই বাংলাদেশ প্রথম অগ্রাধিকারে থাকবে। এরপরও একটি রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে আর্থিক সংকট এড়ানো নিশ্চিত করতে অন্যান্য দেশ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১.২ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ এবং আইএমএফ’র কাছ থেকে বেইল-আউট হিসেবে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে আরও অনেক বেশি। শেখ হাসিনার অধীনে বিদেশে পাচার হওয়া প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু অংশ উদ্ধারে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। বাংলাদেশকে বাঁচাতে পশ্চিমা ঋণদাতা ও ভারত যদি পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে তারা তাদের বদলে চীনের কাছে ঋণের মুখাপেক্ষী হয়ে উঠতে পারে। এরই মধ্যে তারা প্রতিশ্রুত অনুদান ও ঋণের আরও ৫ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়েছে, তিন মাস ক্ষমতায় থাকার পর ড. ইউনূসের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে নির্বাচনের জন্য একটি ‘টাইমটেবিল’ ঘোষণা করা। সেটা হতে পারে এক বছর বা এর কাছাকাছি সময়ের মধ্যে। আইনি এবং নির্বাচনি সংস্কারের জন্য কেন এ বিলম্বের প্রয়োজন তা ব্যাখ্যার জন্য তাকে আরও কিছু কাজ করতে হবে।
এই সংস্কার দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করবে। ড. ইউনূস দেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হওয়ায় বহু মানুষ উল্লাস করেছেন। কিন্তু কীভাবে তিনি দেশ শাসন করবেন এবং কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন তার একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে তিনি বেশি দেরি করলে বাংলাদেশের বিপ্লব অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারে।