রাজনৈতিক দলগুলো বহু দফা আলোচনা শেষে জুলাই সনদের খসড়া প্রস্তুত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে পাঠিয়েছে। এই কমিশন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জুলাই সনদ ঘোষণার পরিকল্পনা করছে, তবে বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো বৈচিত্র্যময় মতবাদ ও সংকটের মুখোমুখি হয়েছে দলগুলোর মধ্যে। বিবিসি বাংলার রিপোর্টে জানা গেছে, বিএনপি মনে করে, নির্বাচিত সংসদই এই সনদ বাস্তবায়ন করবে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদ ভাষ্য দিয়েছেন, এই সনদ গঠনে গণভোট বা গণপরিষদ নির্বাচন কিংবা অধ্যাদেশের মাধ্যমে কার্যকরী আদালতের রায় ও প্রাধান্য থাকবে। ফলে, এই পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর মতামতের দিকে তাকিয়ে আছে। সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, “এ সিদ্ধান্ত আসলে রাজনৈতিক দলগুলোরই সিদ্ধান্ত, আমরা কোনো চাপ প্রয়োগ করব না।” এছাড়াও, তারা দলগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা করে এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। বিএনপি যদিও এর আগে অনড় অবস্থানে ছিল, এখন তারা আলোচনায় আগ্ৰহী বলে জানিয়েছে। বিএনপি স্ট্যান্ডার্ড কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, “আমরা মনে করি, এ আলোচনা মধ্য দিয়ে একটা সমাধানে আসা সম্ভব। আমরা অংশগ্রহণ করব।” অন্যদিকে, এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর মেনে নেয়া এখন বলছেন, আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন জরুরি। তারা দ্রুত এই সনদ গণভোট বা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পন্ন করার তাগিদ দিচ্ছেন। দীর্ঘ আলোচনার পরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর মতামত ও যৌথ ধারণা অনুযায়ী খসড়া প্রস্তুত করেছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে এই সনদ তৈরি করা হয়েছে। এই সনদ প্রচলিত আইন বা আদালতের রায়ের ওপর ভিত্তি করে প্রাধান্য পাবে এবং এর জন্য একটি বিশেষ সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। কমিশনের লক্ষ্য, এই সনদের আইনি ভিত্তি দৃঢ় করিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলার অপশন বন্ধ রাখা। এই বিষয়গুলো নিয়ে তারা গত সপ্তাহে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছে। জুলাই সনদকে সর্বোচ্চ আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে বিশেষ পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জন্য আইনি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল সৃষ্টি করা হয়েছে। অধ্যাপক রীয়াজ বলছেন, “সাবেক বিচারপতি, আইনের শিক্ষক, সিনিয়র আইনজীবীদের মতামত নিচ্ছি। তাদের কাছ থেকে এখন একটা অপশন আসবে।” এই প্যানেল জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শ দেবে, যা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য উপস্থাপন হবে। এ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্যানেলটি আগামী ২৫ অগাস্টের পরে দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে। রীয়াজ যোগ করেছেন, “আগামী সংসদে কীভাবে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করা যাবে, সেটাই মূল বিষয়। এ ক্ষেত্রে, জুলাই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হলে তা সংসদ নির্বাচনের আগে বা পরে কার্যকর হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” সম্প্রতি, ৫ अगस्त অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণাপত্রে জুলাই বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও কিছু দল, যেমন এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী, এই ঘোষণায় হতাশা প্রকাশ করছে এবং বলে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে অচিরে গণভোট বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে কার্যকর করা দরকার। মূলত, ঐকমত্য কমিশন প্রথমে যে খসড়া অঙ্গীকারনামা তৈরি করে ছিল, তা অনুযায়ী, নির্বাচিত সরকারের দুই বছরের মধ্যে এই সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, “আমরা মনে করি, এই সিদ্ধান্ত এবং যে বিষয়গুলো একমত হয়েছে, তা আসলে পরবর্তী সংসদই বাস্তবায়ন করবে।” অন্যদিকে, জামায়াত, এনসিপি, ইসলামিক আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদ এই সরকারের সময়েই গণভোট বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই সনদ বাস্তবায়ন চায়। এনসিপি বলছে, জুলাই অভ্যুত্থানে অনেক প্রাণহানির পর যে সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি হচ্ছে, যদি তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাড়া বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তার বাস্তবায়নের ব্যাপারে শঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে। এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, “জুলাই সনদকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় আইনি ভিত্তি দিয়ে গঠিত হওয়া উচিত। গণপরিষদ নির্বাচনই আমাদের মূল সমাধান। যদি বর্তমান সরকার এই সনদকে আইনিভাবে মঞ্জুর না করে বাধা দেয়, তাহলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাব।” একই অবস্থানে আছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও। তারা বলছেন, “সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার জরুরি এবং এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিশ্রুতি। এজন্য, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন অপরিহার্য। না হলে আমাদের আন্দোলনে নামো লাগবে।” তবে বিএনপি এই বিষয়ে একটু কৌশলী রূপে অবস্থান নিয়েছে। তারা জানায়, চলতি মাসে আলোচনার জন্য যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, তাতে অংশ নেবে এবং প্রস্তাবনা শুনবে। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যাব। তারা কি প্রস্তাব দেয়, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে, আর বাস্তবায়নের জন্য অন্য কোনো বিকল্প প্রস্তাব আসে কি না সেটাও দেখা হবে।” এরপর, বিভিন্ন সংস্কার কমিশন ও ঐকমত্য কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আরও কিছু সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে গেছে। প্রথম পর্বে ৮৪টি বিষয় নিয়ে ঐকমত্য হয়, যেখানে বেশ কিছু প্রস্তাবের ওপর ভিন্ন মত থাকলেও বেশির ভাগ সিদ্ধান্তে ঐকমত্য প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে আরও ২০টি মৌলিক সংস্কার বিষয় আনা হয়, যার মধ্যে ১১টি বিষয়ে ঐকমত্য-মত ও ৯টি বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশিত হয়। সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, “এই জুলাই সনদ মূলত একটি রাজনৈতিক ডকুমেন্ট, যা ঐকমত্যের ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছে।” তবে, এই খসড়ায় কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যেখানে দলগুলো একমত নয়, সেগুলোর বিস্তারিত দলগত নোট অব ডিসেন্ট দেয়া হয়েছে। সবশেষে, বিবিসি বাংলার রিপোর্ট অনুযায়ী, এই পুরো প্রক্রিয়া ও আলোচনা চলছে এখনো, যেখানে রাজনৈতিক মতামত ও আইনি দিক ধারাবাহিকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।