বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে যে, দুর্নীতি, লুটপাট ও নৈর্ব্যক্তিক অব্যবস্থাপনার কারণে ধুঁকতে থাকা নয়টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আমানতকারীদের অর্থ দ্রুত ফেরত দিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সাথে অনুষ্ঠিত জরুরি বৈঠকে নেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রয়োজনীয় আইনানুগ প্রক্রিয়া শুরু করার অনুমোদন দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩ অনুযায়ী, লাইসেন্স বাতিলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবসায়ন করা হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সকল তথ্য পরিবেশিত হয়েছে ব্যাংকের রেজুলেশন বিভাগে, যাতে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা সহজে তাঁদের টাকা ফেরত পান। এসব কর্মচারীর চাকরি ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
বন্ধের জন্য মনোনীত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: পিপলস লিজিং ও ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, আভিভা ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স ও ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ও ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং ও ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স এবং প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠানের বন্ধকদের মাধ্যমে সরকারের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেজুলেশন ডিপার্টমেন্ট ইতিমধ্যে এই অবসায়নের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে।
পর্যালোচনায় জানা গেছে, এই নয়টি প্রতিষ্ঠানের ঋণের বড় অংশ খেলাপি। এফএএস ফাইন্যান্সের মোট ঋণের ৯৯.৯৩ শতাংশই খেলাপি, যার লোকসান প্রায় ১ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। ফারইস্ট ফাইন্যান্সে ৯৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি, লোকসান এক হাজার ১৭ কোটি টাকা। বিআইএফসি’র খেলাপি ঋণ ৯৭.৩ শতাংশ, লোকসান প্রায় ১ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ইনটেরন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৯৭৫ কোটি, লোকসান ৪ হাজার ২১৯ কোটি। পিপলস লিজিংয়ে ৯৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ, লোকসান ৪ হাজার ৬২৮ কোটি। আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৮৩ শতাংশ, লোকসান ৩ হাজার ৮০৩ কোটি। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৭৫ শতাংশ, লোকসান ৯৪১ কোটি। জিএসপি ফাইন্যান্সে ৫৯ শতাংশ, লোকসান ৩৩৯ কোটি। ও প্রাইম ফাইন্যান্সের ৭৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি, লোকসান ৩৫১ কোটি।
নথি অনুসারে, প্রণীত ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩’ এর আওতায়, লাইসেন্স বাতিলের জন্য এই প্রতিষ্ঠানসমূহকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনের ধারা অনুযায়ী, আমানতকারীর স্বার্থবিপরীত কার্যকলাপ, দায় পরিশোধে অক্ষমতা এবং মূলধন রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য লাইসেন্স বাতিলের সুযোগ রয়েছে। লাইসেন্স বাতিলের আগে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া হয়, যা এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। এর ফলে, সালেহ্লি পরিস্থিতি বিবেচনা করে, এসব প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
বাংলাদেশের চূড়ান্ত আর্থিক খাতে বর্তমানে মোট ৩৫টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকেত দিয়েছে সমস্যা জর্জরিত। এই ২০টি প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের পরিমাণ ২৫,৮০৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২১,৪৬২ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি। খেলাপির হার ৮৩.১৬ শতাংশ, অথচ তাদের অবশিষ্ট সম্পদ মাত্র ৬.৮৯৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৬ শতাংশের কম। অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে ভাল অবস্থায় থাকা ১৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে খেলাপি ঋণের হার মাত্র ৭.৩১ শতাংশ।গত বছর এসব প্রতিষ্ঠানের মোট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা এবং তাদের মূলধনের উদ্বৃত্ত রয়েছে ৬ হাজার ১৮৯ কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের আর্থিক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ৪৮,৯৬৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে সমস্যা রয়েছে এমন ২০টি প্রতিষ্ঠানের আমানত রয়েছে ২২,১২৭ কোটি টাকা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা রয়েছে শক্তিশালী ৫,১৬৪ কোটি টাকা। গ্রাহকদের নিট ব্যক্তিগত আমানত আনুমানিক ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, অবসায়ন ও পুনর্গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে এই অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠানসমূহের অবসায়নের পর, এই খাতে কর্মরত সকল কর্মচারীরা চাকরি ও সুবিধা পাবেন বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।