গাজা উপত্যকা এখন পুরোপুরি ধ্বংসের স্তূপে পরিণত হয়েছে, চারদিকে বোমা বর্ষণের ফলে বাড়ি-ঘর, দামাল লাশ এবং রক্তে ভিজে রয়েছে পথের প্রকৃতি। এই পরিস্থিতিতে গাজা সিটির বাসিন্দারা জীবন বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে ছুটছেন, চেষ্টা করছেন কোথায় যেন নিরাপদ আশ্রয় পেতে।
বহুকালের ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞের পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একটি অস্থায়ী গেটওয়ে খুলে দিয়েছে গাজার মানুষরা যেন পালাতে পারেন। তবে, এ সুযোগ মাত্র ৪৮ ঘণ্টার জন্য। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা, বিবিসি, এপি, সিএনএন ও রয়টার্সের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সালাহউদ্দিন সড়ক দিয়ে দক্ষিণের দিকে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এই পথ দিয়ে যেতে হবে, কিন্তু কোথায় যাবে তার কোনও চূড়ান্ত নির্দেশনা বা গন্তব্য এখনো নিশ্চিত নয়। অজানা ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলা মানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, যেন এটি মুক্তির পথ নয়, বরং এক অনিশ্চিত জীবনযুদ্ধ।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র অ্যাভিচাই আদ্রি জানিয়েছেন, বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টা কল্যাণে সালাহউদ্দিন সড়ক ব্যবহার করে গাজা সিটির বাসিন্দারা দক্ষিণে যেতে পারবেন। তবে, এই রুটটি সরাসরি অন্য দিকে যাচ্ছে না; এটি একটি নেটজেরিম করিডর দিয়ে গাজাকে বিভক্ত করে রেখেছে, যা ২০২৪ সালে ইসরায়েল নিরাপত্তা অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। এই পথটি মূল রাস্তার তুলনায় প্রায় ১.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। আদ্রি আরও জানিয়েছেন, শহরের কেন্দ্রীয় সালাহউদ্দিন সড়কের ভেতর দিয়ে অন্য একটি বিকল্প পথও খোলা হবে।
গাজার শেখ রাদওয়ান এলাকার ৩২ বছর বয়সি মা লিনা আল-মাঘরেবী বিবিসিকে বলেছেন, তাঁতের খরচ জোগানোর জন্য গহনা বিক্রি করতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কূটকৌশলটি আসলে গাজাবাসীদের মুক্তির পথ নয়, বরং অবরুদ্ধ জনগোষ্ঠীকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়ার পরিকল্পনা। কারণ, পথে গেলেও তাদের জীবনের নিশ্চয়তা আপাতত নেই।
অবশ্য, এই ঘোষণা আসার আগেই শহরটিতে ইসরায়েলির হামলা আরও বাড়ছে। মঙ্গলবার থেকে শুরু হয় ব্যাপক স্থল অভিযান। গাজা সিটির উত্তর-পশ্চিমের শেখ রাদওয়ান এলাকায় বোমা ভর্তি রোবট দিয়ে আঘাত হেনেছে ইসরায়েলি সেনারা। শহরজুড়ে তীব্র হামলা অব্যাহত থাকায় অসংখ্য বাসিন্দা ঘর থেকে বের হয়ে আসছে।
গাজা সিটির আল-রানতিসি শিশুহাসপাতালেও চলেছে ইসরায়েলি বর্বরতা। হাসপাতালে হামলার নিন্দা জানিয়ে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা এ ধরনের ধারাবাহিক হামলার শিকার হয়েছে; তবে এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ধারণা করা হচ্ছে, কমপক্ষে ৪০ জন রোগী হাসপাতালে থেকে পালিয়ে এসেছে।
এছাড়াও, দেইর আল-বালাহতে গুলিবর্ষণ ও আর্মড হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় আরও ৫১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই গাজা সিটির বাসিন্দা।
গাজায় চলমান এ মার্কিন-প্রচণ্ড স্থলহামলায় দুই ডিভিশনের প্রায় ২০ হাজার সেনা অংশ নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এতে শহরের সুযোগ-সুবিধা যেমন দ্রুত বন্ধ হয়ে গেছে, তেমনি টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পুরো শহরটি বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে গেছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা করছে ইউরোপীয় কমিশন, যা ইসরায়েলের সঙ্গে বিশেষ বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। মূলত, ২০২৪ সালে ইসরায়েল ও ইউরোপের মধ্যে মোট বাণিজ্যের ৩৭ শতাংশই এই সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তির আওতায়।
ইউরোপীয় বৈদেশিক নীতি প্রধান কাজা কাল্লাস বলেছেন, এই পদক্ষেপ ইসরায়েলের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। তবে, এটি কার্যকর করতে হলে ইউরোপের সব সদস্য দেশের সম্মতিপ্রাপ্ত সমর্থন দরকার, যা সহজ নয়।
এদিকে, গাজার অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মানবিক সহায়তা জোরদার করতে আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন মানবাধিকার ও সাহায্য সংস্থার নেতারা। তারা বলছেন, চলমান যুদ্ধের কারণে এখানে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৬৪ হাজার ৯৬৪ জন, আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩২১ জন। এই ভয়াবহ সংকটে গাজা পুনরুদ্ধারে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।