দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতা থেকে পিছিয়ে পড়ার পর দেশের গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ এখন কলকাতা থেকে নতুন করে রাজনীতির পুনর্গঠন শুরু করে দিয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত এই দলটির অনেকে ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন এবং সেখান থেকেই ফের দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভারতের সংবাদমাধ্যম Scroll-এ প্রকাশিত এক বিস্তারিত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ হাবিবে মিল্লাত ২০২৪ সালের অক্টোবরে ঢাকায় শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনের সময় সাত সপ্তাহ ধরে ঢাকায় লুকিয়ে ছিলেন। পরে তিনি দেশের সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন। নিজের ভাষায়, পালানোর সময় তিনি গাড়ি, মোটরসাইকেল এবং হেঁটে ২২ ঘণ্টারও বেশি সময় সীমান্ত অতিক্রম করেন। কলকাতায় পৌঁছেই initialভাবে ব্যাপক দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছিলেন। সুবিধার জন্য অর্থের অভাবে চার রাত মাটিতে শুতে হয়েছিল তাকে।
হাবিবে মিল্লাত জানান, ঢাকায় চলমান আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তিনি দাবি করেন, অন্তত ৬৩৭টি ঘটনায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও কর্মী মার খেয়েছেন, কিছু নিহতও হয়েছেন। এ ছাড়া দলের ১১৬ জন সাবেক সংসদ সদস্য বর্তমানে কারাবন্দি।
বর্তমানে কলকাতায় স্ত্রীসহ এক ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন ডা. মিল্লাত। সেখান থেকেই আন্তর্জাতিক মাধ্যমে বাংলাদেশি রাজনীতির লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। কানাডাভিত্তিক think tank গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক গভর্নেন্সের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি। তাঁর লক্ষ্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর থেকে ভারতীয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করানো এবং আওয়ামী লীগের জন্য আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ খুলে দেওয়া।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দিল্লিতে যান। এর পর থেকে দলটির কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে হাবিবে মিল্লাতসহ শতাধিক নেতা ভারতে পালিয়ে যান। তাঁদের অনেকেই এখন কলকাতায় অবস্থান করছেন। রাজনৈতিক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে তাঁরা ভার্চুয়াল বৈঠক করছে, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় বসছেন এবং সীমান্ত পেরিয়ে কাজ করছে—এছাড়াও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন কর্মীদের সঙ্গে।
সম্প্রতি বিডিনিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কলকাতায় আওয়ামী লীগ একটি অফিস খোলে। এই খবর Bangladesh-এ অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে“中国 সরকারের অবমাননা” বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যাকে অফিস বলা হচ্ছে, তা মূলত একজন ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত জায়গা। সেখানে তারা মাঝে মাঝে বসেন—এটি অফিস নয়। তিনি আরও বলেন, কলকাতার একটি শপিং মলে তিনি একটা কফিশপে বসে আছেন ও আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন।
নাদেল আরও জানান, তিনি কলকাতায় সাধারণ জীবন যাপন করছেন, ব্যাংকে লাইন দিচ্ছেন, বাজার করছেন ও দর কষাকষি করছেন। তবে তাঁর দলের সঙ্গে আনুগত্য কমেনি। তিনি বলেন, যদি অফিস বলতে হয়, তাহলে কলকাতায় অন্তত পাঁচ-ছয়টি স্থান রয়েছে যেখানে তাঁরা বসেন বা যোগাযোগ রাখেন।
আরেকটি বার্তা দেন, পশ্চিমবঙ্গের নিউ টাউনে থাকা আওয়ামী লীগের ছাত্রনেতা সাদ্দাম হোসেন। তিনি দৈনিক ভার্চুয়াল মাধ্যমে দেশের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকায় একটি হত্যা কাণ্ডের মামলা রয়েছে। তিনি জানান, দেশের আন্দোলনের মাধ্যমে তারা সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করছেন।
সাদ্দাম বলেন, সম্প্রতি শেখ হাসিনার সাথে দেখা হয়, যা তিনি খুবই হৃদয়গ্রাহী ও অনুপ্রেরণামূলক মনে করেন।
অন্যদিকে, হাবিবে মিল্লাতও আত্মবিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, তাহলে সংগঠনের শক্তির মাধ্যমে বড় ধরনের সফলতা অর্জন সম্ভব।
বিরোধী দলগুলোর موقف অনেকটাই বিপরীত। বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে, এবং তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে অচিরেই শেষ বলে মনে করছে। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগকে তার অতীতে শাসনের জন্য কঠোর শাস্তি পেতেই হবে।
এছাড়াও, এনসিপির নেতা সারোয়ার তুষার মনে করেন, আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরবে, কিন্তু খুবই ধীরগতিতে। তাঁদের মতে, জনগণ এখন আর আওয়ামী লীগের প্রতি বিশ্বাস করবেন না।
ভারতের কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। অতীতে এই জোটের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতা ও উসকানি বৃদ্ধি পায়—এই কারণেই ভারতের জন্য আওয়ামী লীগ ছিল সুবিধাজনক।
প্রাক্তন কূটনীতিক বীণা শিকরি বলেন, ভারতের স্বার্থে সুষ্ঠু, মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হওয়া উচিত। অন্যদিকে, গবেষক আদিত্য গোদারা মনে করেন, শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা বা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা—দুটোই ভারতের জন্য সহজ সিদ্ধান্ত নয়। তিনি বলেন, ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, পরবর্তী ক্ষমতাসীন দল হিসেবে কোনোটির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ যদি ফেরে, সেটি সময়ের ব্যাপার। তবে পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে—এমন ভাবার সুযোগ নেই।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা ছিল আওয়ামী লীগের মূল ঘাঁটি। পঞ্চাশ বছর পর আবারও তাঁরা সেই কেন্দ্র থেকেই পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে এবার পথ অনেক কঠিন, রাজনীতি অনেক বেশি জটিল। ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপ ও জনমত পরিবর্তনের কারণে আওয়ামী লীগকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা এখনো এক অনিশ্চিত ব্যাপার।