গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’। বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার কর্মী, ত্রাণকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবীরা সমুদ্রপথে একত্রিত হয়ে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের জন্য খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি সরঞ্জামাদি নিয়ে গাজায় যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা এই অভিযাত্রা বিভিন্ন বাধা ও বিপত্তিতে ভরা ছিল। ইসরায়েলি অবরোধ, আটক অভিযান এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে তাদের গাজায় প্রবেশের সেটি সম্ভব হয়নি।
প্রায় ৪৫টি জাহাজে করে অধিকারকর্মীরা গাজায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন, কিন্তু ইসরায়েলি নৌবাহিনী তাদের সামনে বাধা দেয়। বেশিরভাগ জাহাজকে আটক করা হয়, অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এবং ধারণা করা যায় যে, তারা সবাই বর্তমানে আটক রয়েছেন। বৃহষ্পতিবার ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার এই অভিযাত্রা গাজায় পৌঁছানোর আগে শেষ হয়ে গেছে। তারা আরও বলেছেন, এসব জাহাজ আটক করতে গেলে বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি।
রয়টার্সের সূত্রে জানা গেছে, ইসরায়েলি নৌবাহিনী এখন পর্যন্ত ৩৯টি জাহাজকে আটক করেছে। তবে একটির পথ এখনও গাজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহল গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং আটককৃত মানবাধিকার কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারী, রিফিউজি বিরিয়ানি অ্যান্ড বানানাস সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা রুহি লরেন আখতার, সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছিলেন যে, তাদের জাহাজটি শেষ পর্যন্ত ফিরে যায় সাইপ্রাসে। কারণ, তাদের ক্যাম্পে থাকা কয়েকজন যাত্রী “উচ্চ ঝুঁকিতে” थे এবং আটক হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তিনি আরও যোগ করেছেন যে, তারা তাদের সহযাত্রীদের জন্য সোচ্চার হতে চান, আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে চান, এবং গাজায় সহায়তার জন্য নিরাপদ করিডর নিশ্চিত করতে চান।
অবশ্য, এই ফ্লোটিলার মূল লক্ষ্য ছিল গাজায় সরাসরি সহায়তা পৌঁছে দেওয়া। যদিও তা সফল হয়নি, তবুও এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সংগঠকরা বলেছে, “এটি কেবল একটি ত্রাণ মিশন নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। গাজার অবরোধ মানবাধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন।”
ইউরোপীয় গ্রিন পার্টি ইতোমধ্যে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ইসরায়েলের এই আটক অভিযান ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন’। তারা জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আটক যাত্রীদের ছেড়ে দিতে হবে এবং মানবিক সহায়তা অবিলম্বে পৌঁছে দিতে হবে।
তদ্ব্যতীত, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার অভিবাদন বা হামলা চালানোর ঘটনায় ইসরায়েলি নৌবাহিনী অন্তত ৩১৭জন অধিকারকর্মকে আটক করেছে বলে জানিয়েছে আয়োজকরা। তুরস্কের সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
অফিশিয়াল ট্র্যাকারে জানা গেছে, ২১টি জাহাজে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি নৌবাহিনী। ধরা হয়েছে আরও ১৯টি জাহাজেও হামলা হয়েছে বলে ধারণা, আর চারটি জাহাজ গাজায় যাওয়ার পথে রয়েছে। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল অন্তত ৩৯টি জাহাজ আটক করেছে।
এই অভিযানে বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা ছিলেন, যেমন স্পেন, ইতালি, ব্রাজিল, তুরস্ক, গ্রিস, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নাগরিকসহ বহু দেশের অধিকারকর্মী।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আটকৰিত ব্যক্তিদের ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেখানে থেকে তাদের ইউরোপে ফেরত পাঠানো হবে।
অন্যদিকে, ‘মিকেনো’ নামের একটি জাহাজ গাজা উপকূলের কাছাকাছি প্রবেশ করেছিল, কিন্তু যান্ত্রিক সমস্যা বা যোগাযোগ বিঘ্নের কারণে ট্র্যাকিং সিগন্যাল হারিয়েছে। তুরস্কের কর্মীরা জানিয়েছেন যে, এই জাহাজটি গাজার থেকে মাত্র ৩০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা জানায়, গাজার দিকে এগিয়ে যাত্রার সময়ই অবরোধের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে ইসরায়েলি বাহিনী। তারা কার্গো জাহাজগুলো ঘিরে ফেলে এবং বেশিরভাগেই যোগাযোগ ও সিগন্যাল বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক অধিকারকর্মী এই ঘটনার ভিডিও প্রকাশ করেছেন যেখানে দেখা যায়, ইসরায়েলি নৌবাহিনীর নির্দেশে তাঁদের দিক পরিবর্তনের জন্য বাধ্য করা হচ্ছে।
ফ্লোটিলার এক পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘আমাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা। বেশ কয়েকটি জাহাজ আটক করে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেনারা জাহাজে প্রবেশ করে এগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ নেয়।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইসরায়েলি বাহিনী বেশ কয়েকটি জাহাজে হামলা চালায়, জলকামান ও সহিংসতা ব্যবহার করে। ৫০টি দেশের শান্তিপ্রিয় কর্মীদের বিরুদ্ধে নির্মম আচরণের অভিযোগ উঠেছে।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে, কিছু কর্মীকে আটক করা হয়েছে এবং তাদের লোকজনকে আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তারা বলেছে, ফ্লোটিলার অন্যান্য জাহাজগুলো পরীক্ষা করে সেগুলো থেকে সাহায্যসামগ্রী গাজায় পাঠানো হবে।
সর্বশেষ, এই অভিযান ৩১ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে শুরু হয়েছিল, এরপর অন্যান্য দেশ থেকে আরও নৌযান যোগ দেয়। এই অভিযানে মূলত মানবিক সাহায্য ও ওষুধপত্র ছিল। বহু বছর ধরে চলমান গাজা অবরোধের অংশ হিসেবে এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়। এই অবরোধ মার্চ মাসে আরও কঠোর হয়, ফলে গাজায় খাদ্য ও ওষুধের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায় এবং অঞ্চলটি দারুণভাবে দুর্বল হয়।
২০২৩ সালে ইসরায়েলি হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলেছে, গাজা বসবাসের অযোগ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে, জায়গাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অভুক্ত ও অসুস্থতার চেহারা।