চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হার প্রায় ৪.৮ শতাংশের মতো হতে পারে, যা অর্থনীতির বেশ উন্নতি সূচক। মুদ্রাস্ফীতির উপর নিয়ন্ত্রণ আসার ফলে ব্যক্তিগত খরচে কিছুটা বৃদ্ধি ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, আর ফলস্বরূপ গত অর্থবছরের তুলনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও শক্তিশালী হবে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে এ সকল পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরও জোরদার হয়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছানোর আশার কথাও জানানো হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরা হয়। এ সময় প্রতিবেদনটির সাথে সাথে এশিয়ার ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক আরেকটি রিপোর্টও প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন বিশ্বব্যাংকের ডিভিশনাল ডিরেক্টর জেন পেসমি, ঢাকা অফিসের চীফ ইকনোমিস্ট ফ্রানজিসকা লেসলোট ওহসেজ, এবং ইকনোমিস্ট নারজুস সাকিব খান। এ ছাড়াও, সিনিয়র এক্সটারনাল অফিসার মেহেরিন এ মাহবুবও বক্তব্য দেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগের পরিমাণ সামান্য বৃদ্ধি পাবে। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এই দ্রুত প্রবৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি, যদি আমদানি স্বাভাবিক হয়, তাহলে চলতি হিসাবের ভারসাম্য সামান্য ঘাটতির দিকে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থনীতির উন্নতির সাথে সাথে কর রাজস্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় জিডিপিতে দেশের রাজস্ব ঘাটতি ৫ শতাংশের নিচে থাকবে বলে দেখানো হয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতির দিক থেকেও প্রতিবেদনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসগুলিতে এটি ধীরেধীরে কমছে, তবে ২০২৫ সালের আগস্টে এটি ৮.৩ শতাংশে পৌঁছেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের নভেম্বরের ১৩.৮ শতাংশ থেকে কমে ২০২৫ সালের আগস্টে ৭.৬ শতাংশে নেমেছে। বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকার পাশাপাশি খাদ্য সরবরাহ পুনরুদ্ধার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে এই উন্নতি।
অল্প আয়ের মানুষজনের মধ্যে মজুরি এখনও মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে বেশি হারে বৃদ্ধি পেলেও, সাম্প্রতিক সময়ে এই ব্যবধান কমে আসছে। তবে, দারিদ্র্য হার এখনও বেড়েই চলেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২১.২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০২৪ সালে ছিল ২০.৫ শতাংশ। শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হারও কমে গেছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এটি ৬০.৯ শতাংশ থেকে নেমে ৫৮.৯ শতাংশ হয়েছে, যার মূল কারণ হলো নারীদের অংশগ্রহণ হ্রাস। এ সময়ে প্রায় ৩০ লাখ কর্মক্ষম বয়সী মানুষ শ্রমশক্তির বাইরে চলে গেছেন, যার মধ্যে ২.৪ মিলিয়ন নারী। পাশাপাশি, মোট কর্মসংস্থান প্রায় ২০ লাখ কমে ৬৯.১ লাখে দাঁড়িয়েছে, ফলে কর্মসংস্থান-জনসংখ্যার অনুপাত ৫৬.৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা দুর্বার সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। খেলাপি ঋণের সমস্যা এখনো প্রবল, এবং মূলধন-ঝুঁকি-সম্পদের অনুপাত ৬.৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ১০ শতাংশের চেয়ে অনেক নিচে। সরকার এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় দুর্বল ব্যাংকগুলো মার্জ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়াও, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাসনব্যবস্থা ও পরিচালনাগত স্বাধীনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংকের কর্পোরেট শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে আইনি কাঠামো উন্নত করার পরিকল্পনাও চালানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি, আমানত সুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত এবং জরুরি তরলতা সহায়তা কাঠামো প্রস্তুত করা হয়েছে।
২৭১২০২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সামান্য হ্রাস পেয়ে ৪.০ শতাংশে নেমেছে, যা ২০২৪ সালে ছিল ৪.২ শতাংশ। বিনিয়োগের অপ্রতুলতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। সরকারি বিনিয়োগও ধীরগতিতে চলিত হয়েছে, ফলে মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাত্র ০.৮ শতাংশ।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে কর-রাজস্ব আয়ের গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের কর-জিডিপি হার খুবই কম, যা একটি টেকসই উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।