প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বক্তব্য নিয়ে আইনজীবীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীদের কেউ কেউ মনে করেন, প্রধান বিচারপতি সঠিকই বলেছেন। অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা সমীচীন নয়। এটা সংবিধানপরিপন্থী। এর নেতিবাচক দিক তুলে ধরে একজন আইনজীবী বলেন, ‘বিচার প্রার্থীরা মামলা জেতেন কিন্তু রায় হাতে পাওয়ার আগেই মারা যান।’ আবার অনেকে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, প্রধান বিচারপতির এ বাণী কোনো রায় নয়। ব্যক্তিগত মতামত। বিচারপতিরা অবসরে গিয়ে রায় লিখলে তাতে দোষের কিছু হবে না। প্রধান বিচারপতি হয়তো রায় লেখার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনতে এমন মতামত দিয়েছেন। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বক্তব্যটি খোদ প্রধান বিচারপতির হওয়ায় এর আইনগত নানা বিশ্লেষণের চেয়ে রাজনৈতিক গুরুত্ব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা, ‘বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানপরিপন্থী বলে যে রায় দিয়েছিলেন, তাতে তিনি স্বাক্ষর করেন অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর।’ আর এ রায়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জোট। তারা এখনও নির্বাচনকালীন একটি নির্দলীয় সরকারের পক্ষে জোরাল অবস্থানে রয়েছে। মূলত এ কারণেই প্রধান বিচারপতির এ মন্তব্যটিকে লুফে নিয়েছে বিএনপি। ১৭ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধান বিচারপতি জাতির উদ্দেশে একটি বাণী দেন। এতে তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের পর দীর্ঘদিন ধরে রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধানপরিপন্থী।’ অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি বলার ব্যাখ্যায় বিচারপতি সিনহা তার বাণীতে বলেন, ‘কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন, বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না।’ এদিকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, প্রধান বিচারপতি একটা বাণীতে এটা বলেছেন। এটাতো কোনো রায়ে বা আদালতে বসে বলেননি। এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা নিতান্তই তার ব্যক্তিগত অভিমত। ওটা কোর্টের কোনো অভিমত নয়। বর্তমান অবস্থাতে কোনো কোনো বিচারক রায় লিখতে অনেক বিলম্ব করছেন। অনেক বিচারপতির কাছে অনেক বেশি ফাইল থাকতে পারে, সে পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো বলেছেন। কিন্তু তার বক্তব্যকে লুফে নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। প্রধান বিচারপতির বাণীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, যখন বিচারপতি রায় ঘোষণা করেন, তখন তিনি বিচারক হিসেবে শপথে ছিলেন। ঘোষিত তারিখের দিন হিসেবেই রায়ে স্বাক্ষর করা হয়। এ চর্চা দীর্ঘদিনের। তাছাড়া রায় লিখতে সময় লাগে। অবসরের পরে রায় লেখা যদি অসাংবিধানিক হয়, তাহলে মাসদার হোসেন মামলাসহ অনেক মামলাই হয়তো টিকবে না। কারণ মাসদার হোসেন মামলার রায় বিচারপতি মোস্তফা কামাল অবসরে যাওয়ার পরে লিখেছিলেন। আর এ চর্চা ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান এমনকি ইংল্যান্ডেও আছে। তাই অবসরের পর রায় লেখা অসাংবিধানিক হয়ে যাবে- এটা হতে পারে না। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার এ ব্যাপারে বলেন, রায় ঘোষণার সময় বিচারপতিদের শপথ থাকে। কিন্তু অবসরে গিয়ে রায় লেখার সময় তার আর শপথ থাকে না। এজন্যই প্রধান বিচারপতি হয়তো বলতে চাচ্ছেন- অবসরে যাওয়ার পরে রায় লেখাটা অসাংবিধানিক হয়ে যায়। অ্যাডভোকেট মজুমদার আরও বলেন, অবসরের পর অনেক বিচারপতি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও অংশ নিচ্ছেন। অনেকে অবসর পরবর্তীতে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও চাকরি নিচ্ছেন। তাই অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখাটা অনৈতিক। তাই বিচারিক দায়িত্ব পালনকালেও (ইন সার্ভিসে থাকাবস্থায়ও) একজন বিচারপতির দ্রুত রায় লেখার কাজ শেষ করা উচিত। এতে বিচারপ্রার্থীরা উপকৃত হবেন। প্রবীণ এ আইনজীবী আরও বলেন, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক অবসরে যাওয়ার পরে অনেক কথা বলে বেড়াচ্ছেন। প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে নানা কথাও বলছেন। এটা নিয়ে তারা বিতর্কে গেছেন। কিন্তু বিচারপতি মানিক যেগুলো এখন বলে বেড়াচ্ছেন সেগুলো তিনি চাকরিতে থাকাবস্থায় বললেন না কেন (?) চাকরিতে থাকাবস্থায় বললে তো জাতি উপকৃত হতো। কিন্তু এখন যা করছেন তা দুঃখজনক। তিনি বিচার বিভাগকে মানুষের কাছে বিতর্কিত করে দিচ্ছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, বিচারক যখন বিচারক হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন, তখন যদি তিনি রায়টা ঘোষণা করেন, পরে সে রায় লিখতে কোনো বাধা নেই। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বিচারক কিন্তু মামলার ফলাফল আগেই বলে দিয়েছেন, যা পরে লেখা হচ্ছে মাত্র। অবসর নেয়ার পর বিচারক হিসেবে শপথ থাকে না বলে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সৈয়দ আমিরুল বলেন, ‘উনি বলছেন বিচারক যখন শপথ নেন, অবসরে গেলে আর শপথ থাকে না। আমি বলতে চাই, যখন শপথ থাকে না, অর্থাৎ আমি যখন শপথের আওতায় নেই, তখন আমি নতুন করে কোনো রায় দিতে পারব না। কিন্তু আমি যখন বিচারক ছিলাম তখন যে রায় ঘোষণা করেছি, সেই রায়টা অবসরে গিয়ে লিখতে আমার সাংবিধানিক বা আইনগত কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে বলে আমি মনে করি না।’ প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, রায় দেয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে।
প্রধান বিচারপতি তার বক্তব্যের মাধ্যমে হয়তো একটা তাগিদ দিয়েছেন, যেন তাড়াতাড়ি রায় লেখা হয়। তিনি আরও বলেন, আমার কাছেই এমন মামলা রয়েছে, যার রায় এক বছরেরও বেশি সময় আগে ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু আজও রায়ের কপি হাতে পাইনি। তাছাড়া প্রধান বিচারপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন এটা কোনো রায় নয়। এটা একটা বাণী। আমার মনে হয় না এটা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ আছে। সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এমকে রহমান বলেন, অবসরে গিয়ে রায় লেখা সংবিধানপরিপন্থী প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। কারণ একজন বিচারক শপথ নিয়ে তার দায়িত্ব পালন করেন। যেদিন তার বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হয়েছে সেদিন তিনি আর শপথের আওতায় থাকেন না। ফলে অবসরের পর কোনো বিচারকের ফাইলে স্বাক্ষর করা উচিত নয়। সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম মহসিন রশিদ বলেন, অনেক মামলা রয়েছে যার রায় বছরের পর বছর ধরে দেয়া হয় না। এমনকি আপিল বিভাগেও অনেক রায় বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। যেসব বিচারক ওইসব মামলা শুনেছেন তারা ইতিমধ্যে অবসর নিয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগে ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কিছু রায় ঝুলে আছে। আর ঝুলে থাকা রায়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, বিচার প্রার্থীরা মামলা জেতেন কিন্তু রায় হাতে পাওয়ার আগেই মারা যান। বিচারকরা চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পরেও মামলার রায় লেখেন, কিন্তু তখন তারা শপথের আওতায় থাকেন না। শপথের আওতায় না থেকে রায় লেখা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। অবসরের পর দেয়া স্বাক্ষর করা রায় মূল্যহীন কাগজের টুকরো মাত্র। উন্মুক্ত আদালতে রায় দেয়ার চর্চা হারিয়ে গেছে। যদি পূর্ণাঙ্গ রায় উন্মুক্ত আদালতে দেয়া হয় তাহলে দুর্নীতির চর্চার সুযোগ অনেকাংশে কমে যাবে। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে তিনি বলেন, একজন বিচারক অবসরে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় লিখেন, যা বেআইনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশ পূর্ণাঙ্গ রায়ে বদলে ফেলা হয়েছিল। যা জাতির সঙ্গে প্রতারণার শামিল। মহসিন রশিদ বলেন, একজন বিচারক জানেন তিনি কখন অবসরে যাবেন। অবসরে যাওয়ার কয়েক মাস পূর্বে হাইকোর্টের কোনো বিচারককে একক বেঞ্চের এখতিয়ার দেয়া উচিত। পাশাপাশি মামলার সংখ্যাও কমিয়ে দেয়া যেতে পারে, যাতে অবসরে যাওয়ার পূর্বেই তিনি রায় লেখা শেষ করতে পারেন