নিবন্ধনের জন্য আবেদিত ৭৬টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কেবল বাংলাদেশ কংগ্রেস ও গণ-আজাদী লীগ প্রাথমিকভাবে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এছাড়া বাকি ৭৪টিই অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জানা গেছে, কমিশন অযোগ্যঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলোই প্রতি বছর আবেদন করে। নিবন্ধনের শর্ত পূরণে বারবার ব্যর্থ হয়েও নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলো আবেদন করার পর প্রাথমিক বাছাইয়ে বাদ পড়ে যায়। যে কারণে প্রত্যেকবারই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাজনৈতিক দল আবেদন করলেও হাতে গোনা দুই-একটি নিবন্ধন পায়।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, জরুরি অবস্থার সরকারের সময়ে দেশে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু হয়। ওই সময় দেশে ১০৭টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে কমিশনে আবেদন করে। এরমধ্যে ৩৯টি দলকে যোগ্য বিবেচনা করে নিবন্ধন দেয় কমিশন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় গঠিত কিংপার্টি খ্যাত একাধিক ‘বিতর্কিত‘ রাজনৈতিক দলও নিবন্ধন পায়। বাকি ৬৮টি দলই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় নিবন্ধন পায়নি। এরপর ২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশন দ্বিতীয় দফায় নিবন্ধনে আবেদন চাইলে তাতে ৪৩টি দল আবেদন করে। এর মধ্যে মাত্র দু’টি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। এই দু’টির মধ্যে একটি দলের নিবন্ধনের শর্ত পূরণ নিয়ে ওই সময়ই বিতর্ক ওঠে।
কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসি গত অক্টোবরে নতুন দলের নিবন্ধনে আবেদন চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে সাড়া দিয়ে নিবন্ধন পেতে ৭৬টি দল আবেদন করে। এর মধ্যে প্রাথমিক তথ্য যাচাইকালে প্রথম দফায় ১৯টি দলকে বাতিল করে বাকি দলগুলোর কাছে আরো তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় ইসি। এতে সাড়া না দিলে দ্বিতীয় দফায় আরও ৮টি দলের আবেদন নাকচ করে। পরে ৪৯টি দলের তথ্য যাচাই করে তার মধ্যে মাত্র দু’টি দলকে প্রাথমিকভাবে যোগ্য মনে করছে কমিশন। জানা গেছে, মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে দল দু’টির প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল পেলেই কেবল দল দু’টিতে নিবন্ধন দেওয়া হবে।
ইসির প্রাথমিক বাছাইয়ে মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার তৃণমূল বিএনপি, জোনায়েদ সাকির জগণসংহতি আন্দোলন ও ববি হাজ্জাজের দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)সহ আলোচিত দলগুলোর কোনোটিই নিবন্ধনে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, নিবন্ধন বাছাই কমিটি নিবন্ধন অযোগ্য দলগুলোকে পাঠানো হবে। সেখানে কী কারণে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি সেটা উল্লেখ করা হবে।
প্রাথমিকভাবে যোগ্য বিবেচিত বাংলাদেশ কংগ্রেস দলের চেয়ারম্যান কাজী রেজাউল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তারা জেনেছেন প্রাথমিক বাছাইয়ে তাদের দলের নাম রয়েছে। তবে,এটি চূড়ান্ত কিছু নয়। তাদের বিষয়ে হয়তো আরও যাচাই-বাছাই হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাছাই কমিটির প্রধান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যাচাই-বাছাই করে কমিশনে রিপোর্ট জমা দিয়েছি। আমরা দু’টি দলের মাঠপর্যায়ে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছি। এখন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা দলগুলোর জমা দেওয়া তথ্য যাচাই করে তাদের যোগ্য মনে করেছি। তবে, এটা চূড়ান্ত নিবন্ধনের সুপারিশ নয়। নিবন্ধনের জন্য মাঠপর্যায়ের তথ্য যাচাইসহ আরও কিছু বিষয় দেখার রয়েছে।’
প্রাথমিক বাছাইয়ে বেশিরভাগ দলই বাদ পড়েছে উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘যা প্রয়োজন, তা দলগুলো পূরণ করতে পারেনি। এখন সবকিছু চূড়ান্ত হয়নি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তালিকা চূড়ান্ত করবো।’
এর আগে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন দলের নিবন্ধনের জন্য যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, এখন তো দেখি নিবন্ধনযোগ্য দল পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। হয় একজন নেতা আছেন, কোনও অফিস নেই, গঠনতন্ত্র ঠিক নেই।’
২০০৮, ২০১৩ ও সর্বশেষ ২০১৭ সালের আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনেক দল রয়েছে, সেগুলো নিবন্ধনের জন্য ইসিতে একাধিকবার আবেদন করেছে। এরমধ্যে কিছু আছে তিনবার আবেদন করেছে। আবার কিছু কিছু দল দুই বার আবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু শর্ত পূরণ না হওয়ায় প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এছাড়া কিছু কিছু দল রয়েছে, সেগুলো প্রথমবারে নিবন্ধনে ব্যর্থ হয়ে পরে দলের নাম কিছুটা পরিবর্তন করে বা একাধিক দল একীভূত হয়ে কিংবা কোনও দল খণ্ডিত হয়ে নতুন করে আবেদন করেছে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, একবার নিবন্ধনে ব্যর্থ রাজনৈতিক দল কার্যত শর্তগুলো পূরণ না করেই দ্বিতীয়বার আবেদন করেছে। যে কারণে তাদের বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব হয়নি।
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ জালালি পার্টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল), কৃষক শ্রমিক পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ হিন্দু লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ভাসানী, জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিসহ বেশ কিছু দল রয়েছে যারা একাধিকবার নিবন্ধনে আবেদন করেছে। কিন্তু শর্ত পূরন না হওয়ায় প্রত্যেকবারই তাদের আবেদন বাতিল হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে বাছাইয়ে তো আমি দায়িত্বে ছিলাম না। কাজেই আগের নিবন্ধন না পাওয়া কেউ আবেদন করেছে কিনা, সেটা যাচাই না করে বলা যাবে না। তবে, আগে আবেদন করে না পেলেও নতুন করে আবেদনে তো আইনগত বাধা নেই। আর আমরা আগে আবেদন করেছে কী, নতুন আবেদন, সেটা দেখছি না। নিবন্ধনের শর্তপূরণ হচ্ছে কিনা, সেটা বিবেচনায় নেবো।’
২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ব্যবস্থা চালুর পর ৩৮টি দল নিবন্ধিত হয়। এরপর নবম সংসদে দু’টি এবং দশম সংসদে দু’টি দল নিবন্ধন পায়। এছাড়া শর্ত পূরণ না হওয়ায় একটি দলের নিবন্ধন বাতিল ও আদালতের আদেশে একটি নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। সব মিলিয়ে এখন বাংলাদেশে ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে, যেগুলো নিজস্ব প্রতীক নিয়ে দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারে।
নিবন্ধনের শর্ত
নিবন্ধন পেতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা-২০০৮-এর এই সংক্রান্ত শর্ত পূরণ করতে হবে। শর্তগুলো হলো—দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেকোনও জাতীয় নির্বাচনের আগ্রহী দলটিতে যদি অন্তত একজন সংসদ সদস্য থাকেন। যেকোনও একটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী অংশ নেওয়া আসনগুলোয় মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ পায়। আরেকটি শর্ত হলো—দলটির যদি একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ (২১টি) প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং অন্তত ১০০টি উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সংবলিত দলিল থাকে, তাহলে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবে।