বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে কাপড় ও সুতা খোলাবাজারে বিক্রি রোধে এবার প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন বস্ত্রশিল্পের উদ্যোক্তারা। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আসা এসব পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি হওয়ায় স্থানীয় উদ্যোক্তারা ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বস্ত্র শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ। এতে মিথ্যা ঘোষণায় ও চোরাই পথে আসা সুতা ও কাপড় নিয়েও উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, যে কোনো ধরনের অনৈতিক পন্থার মাধ্যমে বিপণনকৃত টেক্সটাইল সামগ্রীর অনুপ্রবেশ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। অন্যথায় এ খাতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ফলে গার্মেন্টস খাতের প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়াসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা বন্ধ করে দিতে পারে।
যোগাযোগ করা হলে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন আমাদের প্রতিবেদককে বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এসব অপকর্ম করছেন। এসব কাপড় ও সুতা ধরতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বন্ড কমিশনারেট অফিস বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে। এতে বেশকিছু সুফল মিলেছে। আমরা চাই এই অভিযান অব্যাহত থাকুক। অবশ্য তিনি বলেন, নিয়মিত ব্যবসায়ীরা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নন বলে আমরা মনে করি।
বিটিএমএ সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে রপ্তানিমুখী নিটওয়্যার ও ওভেন খাতের চাহিদার প্রায় ২৩ বিলিয়ন (২৩০০ কোটি) ডলার সরবরাহ করছে স্থানীয় বস্ত্র খাতের মিলগুলো। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে আরো প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের বস্ত্রের জোগান দিচ্ছে স্থানীয় মিলগুলো। বিটিএমএ সভাপতি বলেন, স্থানীয় বাজারে বস্ত্রের চাহিদা প্রায় ৯০০ কোটি ডলারের। বাকি অংশ চোরাই পথে ও মিথ্যা ঘোষণায় আসা কাপড়ের দখলে। তিনি বলেন, বিটিএমএর সদস্যভুক্ত মিলগুলোর বিনিয়োগের পরিমাণ ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। মিথ্যা ঘোষণা ও চোরাই পথে আসা টেক্সটাইল ও সুতার কারণে এ বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে চলমান অভিযান অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে পাঠানো সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে প্রকৃত রপ্তানিকারকরা ‘দুর্নামের’ ভাগিদার হচ্ছেন। তিনি আমাদের প্রতিবেদককে বলেন, যারা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগী সক্ষম করতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিয়েছে সরকার। তবে এ সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামাল কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অনুমোদিত নির্ধারিত গুদামে রেখে তা দিয়ে তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে হবে। এটি বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা বা বন্ড সুবিধা নামে পরিচিত। বন্ডেড সুবিধার কোনো কাঁচামাল, এক্সেসরিজ বা পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে হলে সরকারের প্রযোজ্য শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজনের চাইতে বেশি প্রাপ্যতা দেখিয়ে কাঁচামাল বা এক্সেসরিজ আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে সমজাতীয় পণ্যের উত্পাদনকারী স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা ও বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা (যারা শুল্ক-কর পরিশোধ করে আমদানি করেন) অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েন। ফলে স্থানীয় বস্ত্র ও সুতার মিলগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে। এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, বন্ডেড সুবিধায় আনা গার্মেন্টসের কাঁচামালের শুল্ক-করের পরিমাণ প্রকারভেদে ৬০ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তার চাইতেও বেশি।
১০ মাসে ২২৩ অভিযান এনবিআরের
এদিকে বন্ডের পণ্য ও চোরাইপথে আসা সুতা-কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এনবিআর। এনবিআরের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিস সূত্র জানিয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে রাজধানীর পুরোনো ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ২২৩টি অভিযান চালানো হয়েছে। পুরোনো ঢাকার ইসলামপুর, সদরঘাট, উর্দু রোড, নয়াবাজার ও নারায়ণগঞ্জের টানবাজার এলাকায় এসব অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে সম্প্রতি রাজধানীর বাইরে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, নরসিংদীর মাধবদীসহ কিছু এলাকায় বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে।
এসব অভিযনে বিপুল পরিমাণ বন্ডের কাপড় আটক করা হয়। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিস হিসাব করে দেখেছে, এতে প্রায় ২৫৬ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। আদায় করা হয় ৪৬ কোটি টাকা। অভিযানে ৮৫টি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান আটক করার পাশাপাশি ৮টি গুদাম সিলগালা করা হয়। এছাড়া এ সুবিধা অপব্যবহারের অভিযোগে ৩২৬টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। শুধু তাই নয়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ফৌজদারি মামলাও দায়ের করা শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত সাতটি ফৌজদারি মামলায় বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আসামি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো বিটিএমএর চিঠিতে এনবিআরের এ অভিযানের প্রশংসা করে তা অব্যাহত রাখার দাবি জানানো হয়। এতে বলা হয়, বর্তমান বন্ড কমিশনার হুমায়ূন কবীরের তত্ত্বাবধানে তল্লাশি অভিযান পরিচালিত হওয়ায় অবৈধ সুতা ও কাপড় আটক হচ্ছে। ফলে এ অনৈতিক কার্যকলাপ ক্রমান্বয়ে কমছে।