বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নতুন প্রস্তাবনা দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির মতে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন বাংলাদেশে বর্তমান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনুপযুক্ত। বরং বিদ্যমান এককক্ষবিশিষ্ট সংসদকে আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করে তোলা উচিত।
ঢাকায় বৃহস্পতিবার আয়োজিত জাতীয় সংলাপে এ বিষয় তুলে ধরেন সিপিডির গবেষকরা। ‘প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ কি জাতীয় সংসদের গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সক্ষম?’ শীর্ষক এই সংলাপে অংশ নেন নানা বিশ্লেষক ও গবেষক।
সিপিডি সম্প্রতি সংসদীয় সংস্কার ও জবাবদিহি বিষয়ক এক গবেষণাপত্র প্রকাশের পর, আন্তরিকতা ও বাস্তবতা বিবেচনায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঐকমত্য কমিশনকে অনুরোধ জানিয়েছে যে, তারা চূড়ান্ত হলো এমন প্রস্তাবগুলো থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন বিষয়ক অংশটি বাদ দিন।
গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর নিজাম আহমেদ। প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধান ও নির্বাচন কমিশনের দিক নির্দেশনাসহ বেশ কিছু সংস্কার ধারণা—যেমন বাইক্যামেরালিজম, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি বা নিয়োগ কমিটি গঠন—আইনি দিক থেকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হলেও, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ প্রস্তাবগুলো কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা দলীয় আনুগত্য, পৃষ্ঠপোষকতা এবং ‘বিজয়ী সব পায়’ এর সাংস্কৃতিক চর্চা এসব ধারণাকে প্রতীকী করে তোলে। ফলে, এর মাধ্যমে জবাবদিহি বা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বরং রাজনৈতিক অচলাবস্থা, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ আরও জোরদার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সিপিডি মনে করে, কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া, শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানগত সংস্কারই জবাবদিহি বা সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবে না। এ কারণে, বিদ্যমান সংসদকে শক্তিশালী করতে এবং কার্যকর করার ওপর জোর দেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করে।
সংস্থাটি বলছে, সংসদীয় ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করে তুলতে বেশকিছু বাস্তবাধারিত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোতে বিরোধী দলের এমপিদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ, রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত, স্থানীয় সরকারের আর্থিক স্বাধিকার বৃদ্ধি, নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়ানো এবং দলত্যাগের ক্ষেত্রে আইনি সংস্কার আনয়ন।
সিপিডি মনে করে, শাসক দল যেন নির্বাহী দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করতে পারে, তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদে সরকারের নিয়োগের ক্ষমতা থাকা দরকার। তবে, এসব নিয়োগের বিষয়গুলো সংসদীয় পর্যালোচনা কমিটির মাধ্যমে নিয়মিত পুনর্বিবেচনার সুযোগ রাখা জরুরি।
আলোচনাকে আরও কার্যকর করতে, সংসদীয় কার্যপ্রণালীর জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘গণতন্ত্রের মাধ্যমে আইন বিষয়ক কমিটি’র আদলে, ‘গণতন্ত্র, আইন প্রণয়ন, নির্বাহী ও সংসদীয় আইন কমিশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হতে পারে। এই কমিশন সংবিধান, আইন ও প্রশাসনিক নীতিমালা শক্তিশালী করবে, নাগরিক অধিকার রক্ষা করবে এবং স্থানীয় সরকারগুলোকে আরও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিকশিত করবে বলে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।





















