পোর্টাল বাংলাদেশ ডটকম ডেস্ক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণটি বহুল প্রতিক্ষিত ছিল। যেদিন থেকে প্রচার শুরু হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিবেন, সেদিন থেকেই জনগণের মনে একটা আকাক্সক্ষা এবং আশা ছিল যে, তারা গঠনমূলক কিছু একটা শুনবে। যেহেতু মানুষের মনে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা বিরাজমান, সেহেতু এই ভাষণটি অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অনুমিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে অনেক কিছু বলেছেন কিন্তু জনগণ শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন এমন কথা একটি মাত্র বাক্য বলেছেন। অনেকের মতে ঐ একটি মাত্র বাক্যটিও কোনো নতুনত্ব বহন করে না।
প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন সেগুলোকে চার প্রকারে বিন্যাস্ত করা যায়। প্রথম প্রকার হচ্ছে সরকারের সাফল্যের ফিরিস্তি। দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে বিরোধী দলের বদনাম ও সমালোচনা, তৃতীয় প্রকার কিছু রাজনৈতিক মন্তব্য এবং চতুর্থ প্রকার হচ্ছে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত পদক্ষেপ। এখন প্রথম প্রকারের কথার সারমর্ম। সরকার বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়েছে, সরকার তথ্য প্রযুক্তি গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিয়েছে, সরকার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, সরকার সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীকে চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীতে পদমর্যাদা বাড়িয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীর পদমর্যাদাগুলোকে শোভনীয়ভাবে নামকরণ করেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি করা হয়েছে যার মাত্রা মোট এই মুহূর্তে ৯৭১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে, সরকার ৫৭৭৭টি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে।
এখন প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় প্রকারের বক্তব্যের সারমর্ম। ২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপির শাসন আমলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এত বেশি অবনমিত ছিল যে, দেশে বা বিদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং উনার সমমনাদের মাথা লজ্জায় হেট হয়ে যেত। সে সময় হাওয়া ভবন ছিল যেখান থেকে সমান্তরাল প্রশাসন চলতো। জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দেয়া হতো। মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে নাই।
প্রধান মন্ত্রীর ভাষণের তৃতীয় প্রকার বক্তব্যের সারমর্ম। ২০০৬ সালে অক্টোবরে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছিল। সেই বিএনপির কারণেই ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ ওয়ান ইলেভেন নামক ঘটনা ঘটে। ঐ ঘটনাটি অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অংশ ছিল। এখন বা ভবিষ্যতে আর কোনো অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে না। ওয়ান ইলেভেন সরকার জগদ্দল পাথরের মতো জাতির বুকে চেপে বসেছিল। প্রধানমন্ত্রীর আপন ছোট ভাই ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট নিহত হয়েছিল শিশু অবস্থায়; তার স্মৃতিতে প্রধানমন্ত্রী আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের চতুর্থ প্রকার বক্তব্যের সারমর্ম। বিদ্যমান সংবিধান মোতাবেক ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখ থেকে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবেন। সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন কমিশন তার নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবে। বিদ্যমান সংবিধান মোতাবেক ২৫ অক্টোবর থেকে নিয়ে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন সরকার থাকবে। সেই সরকারের মন্ত্রীসভা সর্বদলীয় হতে পারবে। বিরোধী দলকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে, যদি বিরোধী দল চায় তাহলে তারা বিদ্যমান নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নাম প্রস্তাব করতে পারে যারা যারা মন্ত্রী সভায় থাকবেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে যা নেই। মানুষ আশা করেছিল তার সরকারের আমলে যে সকল কাজগুলোর কারণে মানুষের ক্ষতি হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্বীকারোক্তি থাকবে এবং দুঃখ প্রকাশ থাকবে; কিন্তু ছিল না। বিদ্যমান সাংবাধিক-রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে ২০১১ সালের জুন মাসে জাতীয় সংসদ কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী (তথা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা প্রসঙ্গে সংশোধনী) আনায়নের কারণে; সেই সংশোধনীর উদ্যোক্তা ছিলেন পর্দার পেছন থেকে প্রধানমন্ত্রী নিজেই। মানুষ আশা করেছিল এই মুহূর্তে বিদ্যমান সংকট উত্তরণের জন্য সংকটের উৎসকে সম্পৃক্ত করে কোনো না কোনো প্রস্তাবনা থাকবে; কিন্তু ঐরূপ কিছুই ছিল না।
আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে মারাত্মক কিছু দুর্নীতির কারণে এই সরকারের আমলে; সেগুলোর কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। শেষ বাক্য ২০০৯ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের ২৫ ২৬ তারিখে পিলখানায় সংঘঠিত বিদ্রোহ ও অফিসার হত্যাযজ্ঞে সরকারের বিতর্কিত পদক্ষেপের কোনো উল্লেখ ছিল না। আন্তর্জাতিক বা বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কি পেয়েছে বা পায়নি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রায়-প্রতারিত হয়েছে তার কোনো বর্ণনা ছিল না। রাজনৈতিকভাবে, সংসদের অধিবেশনে এসে মুলতবি প্রস্তাব উপস্থাপন ছাড়া আর কোনো প্রকারের আলোচনার প্রস্তাব বা আলোচনার নামান্তর প্রসঙ্গে কোনো বক্তব্যই ছিল না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে এমন একটি ধারণা দিচ্ছেন যে, মন্ত্রী সভার গঠন কী প্রকারে হবে, এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং এটা সমাধান করতে পারলেই বাংলাদেশের মানুষ উৎকণ্ঠা ও আতংকমুক্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী পুনরায় সাংবিধানিকভাবে অনড় অবস্থান প্রতিফলিত করেছেন তার বক্তব্যের মাধ্যমে। অন্তবর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি তিনি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের কিছু পরে, অন্যত্র প্রধানমন্ত্রীর একজন সম্মানিত উপদেষ্টা বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই অবশ্যই অন্তবর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শেষ হয়েছে ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যা রাত্রি ৭:৫০ মিনিটে। এই বিশ্লেষণটি, পোর্টাল বাংলাদেশ ডটকম ডেস্ক থেকে পাঠকের নিকট উপস্থাপিত হচ্ছে ১৯ অক্টোবর প্রথম প্রহর তথা ০০৫৫ মিনিটে। অর্থাৎ মধ্য রাত্রি ১২:৫৫ মিনিটে। এই অন্তবর্তী পাঁচ ঘণ্টা সময়ে কিছু সংখ্যক একনিষ্ঠ আওয়ামী সমর্থক বুদ্ধিজীবী বা আওয়ামী ঘরানার রাজনীতিবিদ ব্যতিত এমন কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না যিনি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে আশা-উদ্দীপক বলে অভিহিত করছেন। মহাজোটের বাইরের এমন কোনো রাজনৈতিক দল পাওয়া গেল না যারা উচ্ছসিত অন্তরে ভাষণকে স্বাগত জানাচ্ছেন। এমন কোনো বিশ্লেষক পাওয়া গেল না যিনি ভাষণে সংকট নিরসনে আশার আলো দেখছেন। আমরা মনে করি অনেকদিন যাবত যেই কথাটি রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরঘুর করছিল ঐ কথাটি প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে উপস্থাপন করলেন। এটাকে কোনোভাবেই সংকট নিরসনে একটি প্যাকেজ ঘোষণা বলা যায় না। এটি অনুসঙ্গবিহীন একটি প্রস্তাবনা। যদিও এই মুহূর্ত পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, কিন্তু সকল বিশ্লেষণই অঙ্গুলি নির্দেশনা দিচ্ছে, বিএনপি এই ভাষণ নিয়ে বা প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবনা নিয়ে উচ্ছসিত হওয়ার বা উল্লসিত হয়ে স্বাগতম জানানোর কোনো কারণ নেই।
জনগণের মনের আতংক এবং আশংকা যেই পর্যায়ে ছিল সেই পর্যায়েই থেকে গেল।
পোর্টাল বাংলাদেশ ডটকম এর পক্ষ থেকে আরো বিশ্লেষণ আসবে।